ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিতে ’৭১

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

স্মৃতিতে ’৭১

১৬ ডিসেম্বর তারিখটা সময়ের নির্দিষ্ট গতি ধরে আবার ফিরে এসেছে। সে সঙ্গে মনে পড়েছে ফেলে আসা ক’টি ঘটনা ও দৃশ্যাবলী; যা পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছি। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। ভোর। আমাদের পরিবারের সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত। নিজেদের মধ্যে ফিস ফিস করছে, কী হবে? নিয়াজী কি আত্মসমর্পণ করবে? না করলে কী হবে? সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে আমরা ঢাকাবাসীর কী অবস্থা হবে? না, খারাপটা ভাবতে পারছিনে। কারণ, দীর্ঘ ন’মাস ধরে অভূতপূর্ব খারাপ ঘটনা দেখে বা শুনে আরও খারাপ বা অশুভ কিছু দেখতে চাইনে। হে আল্লাহ। নিয়াজী যেন আত্মসমর্পণ করে। আস্তে আস্তে বেলা বাড়ল। সে সঙ্গে আমাদের অস্থিরতা। প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি ঘণ্টাকে যুগ যুগ বলে মনে হচ্ছিল। পরিবারের যুবকরা ট্রানজিস্টারের নব ঘুরিয়ে চেষ্টা করছিল বিদেশী খবরের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থা জানতে। কিন্তু জানা যাচ্ছিল না। সকালে ঢাকার আকাশ দিয়ে তিনটা মিগ উড়ে গেল। ভারতীয় জেনারেল মানেক শ নিয়াজীকে একটা নির্দিষ্ট সময় দিয়েছিলেন আত্মসমর্পণের খবর জানার জন্য। সে সময়ও উৎরে গেল। একসময় সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। পরিবারের বড়দের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা আরও কঠিন ও কালো হয়ে উঠল। বড়দের দুশ্চিন্তার ছাপ কিশোরদের ওপরও পড়ল। তাদের মুখে আর স্বতঃস্ফূর্ত হাসি নেই। তবে বাড়ির ক্ষুদে দস্যুগুলো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা থেকে তখনও বিরত হয়নি। তাদের প্রশ্নেরও কমতি নেই। আজ কেন ঝাঁক ঝাঁক মিগের খেলা আকাশে নেই! গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না কেন? ওদের প্রশ্নে বড়রা ধমকে উঠে বলেন, যাও তো, এখন ভাল লাগছে না। ঢাকা শহরে ইলেকট্রিসিটি বন্ধ। পানি সরবরাহ ব্যাহত। বাইরের পূর্ব ঘোষিত কার্ফু। নিয়াজী আত্মসমর্পণ না করলে সম্মিলিত বাহিনী একযোগে ঢাকা আক্রমণ করবে। সে আক্রমণের ট্যাঙ্ক ও গোলার শিকার হব আমরা অসহায় ঢাকাবাসী। জীবনের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। মুহূর্তে মুহূর্তে পরমায়ু ঝরে পড়ছে। আমরা নিরুপায়! আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমরা বন্দী! বেলা প্রায় আড়াইটে। চারদিকে শীতের একটা হিম হিম ভাব ছড়ানো। তার মাঝে ঢাকা শহর কার্ফুর নিস্তব্ধতা বুকে নিয়ে ঝিমুচ্ছে। আমরা ডাল-ভাত মুখে ঠেলে সবে উঠেছি। হঠাৎ বাড়ির গেটের কাছের রাস্তায় গাড়ির পরিচিত হর্ন শুনে সবাই কান খাড়া করলাম। পরক্ষণে দরজার কড়া নড়ে উঠল। বাড়ির সবাই একযোগে দৌড়ে দরজা খুলতে গেল। দরজা দিয়ে গাড়ির চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে ঢুকলেন মেজভাই বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। তাঁর মুখে হাসি। সে হাসি আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত-ক্লান্ত মুখগুলোতেও ছড়াল। সবারই চোখেমুখে একই প্রশ্ন ঝরে পড়ল, খবর কী? কার্ফু দিয়ে এলো যে! ‘ভাই সহাস্যে জবাব দিলেন, কার্ফু কোথায়? নিয়াজী তো আত্মসমর্পণ করবে বলে ঘোষণা করেছে। এই তো কিছুক্ষণের মধ্যে লে. জে. অরোরার কাছে নিয়াজী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে। তোমরা যারা দেখতে ইচ্ছুক যাও না দেখে এসোগে। আমাদের মধ্যে যারা বাইরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল, তারা সবাই একযোগে বেরিয়ে পড়তে চাইল। আমরা ক’জন বললাম, আপনি আমাদের নিয়ে যান। ভাই বললেন, “জরুরী কাজ আছে। না হয় নিয়ে যেতাম। তোমরা তো জান, যশোর ক্যান্টনমেন্টে ‘ফল’ করার পর কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও অন্য সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে ‘ঢাকা রক্ষাবাহিনী’ বলে আমরা একটি দল গঠন করেছি। বেগম সুফিয়া কামাল ঐ দলের একজন পেট্রন। ঐ দলের ক’জনকে নিয়েই মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের অবাঙালীদের পাহারা দিতে যাচ্ছি। গু- শ্রেণী ওতপেতে আছে লটুপাট ও খুন-খারাবি করার জন্য। তাছাড়া বেশ কিছু মুক্তিবাহিনীর ছেলে যারা স্বজনপরিজন হারিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে, তাদেরও সামাল দিতে হবে। তাই দেরি করতে পারছিনে। যাই। সেজকে বলে যাচ্ছি, ওর গাড়িতে যেও।” সেজভাই মহীউদ্দীন খান আলমগীর আমাদের হাদী লেনের পাড়াতেই ছিলেন। দু’চার মিনিটের মধ্যে চলে এলেন। আমরা ক’জনা কাপড় না ছেড়েই গাড়িতে উঠলাম, ছোটরাও যে যেমন অবস্থায় ছিল, তেমনি গাড়িতে উঠল। নিস্তব্ধ রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলছে। গাড়ি পুরনো শহরের নিমতলীর রেলক্রসিংয়ের কাছে আসতে দোকানপাটগুলোর কাছে বেশ কয়েকজনকে জটলা পাকাতে দেখলাম। তারা আমাদের দেখে প্রথমে কিছুটা অবাক কিন্তু পরক্ষণে অবাকভাব কাটিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে সেøাগান দিয়ে স্বাগত জানাল। আমরা গভীর অনুভূতিতে একাত্ম হয়ে সাড়া দিলাম। গাড়ি এগিয়ে চলল। তৎকালীন রেলওয়ে হাসপাতাল (বর্তমানে কর্মচারী হাসপাতাল) ছাড়িয়ে কার্জন হল পর্যন্ত কোন লোকনিশানা দেখা গেল না। কিন্তু তৎকালীন ডিপিআই অফিসের (বর্তমানে শিক্ষা ভবন) দিকে মোড় নিতে দেখলাম একটা খ- মিছিল। তাতে পঁচিশ বছরের যুবক থেকে দশ বছরের ছেলে আছে। মিছিলের অগ্রভাগের লোকটির হাতে বাঁশের কঞ্চিতে টানানো জয় বাংলা পতাকা। পতাকার ভেতরে রক্তাক্ত বাংলাদেশের মানচিত্র। পতাকাটি দুমড়ানো-মোচড়ানো। মনে হয় ২৫ মার্চের আগে বানানো পতাকা। পাক মিলিটারির নির্যাতনের ভয়ে নিশ্চয়ই এতদিন কোন কিছুর তলে লুকানো ছিল, তাই এ অবস্থা। আমরা অবার এগোচ্ছি। হঠাৎ সেজভাইয়ের মনে পড়ল মুহম্মদ আলী সাহেবের কথা। মুহম্মদ আলী সাহেব তাঁর বন্ধু মানুষ। স্বাধীনতাযুদ্ধে ভাইদের সঙ্গে একযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন। আজকেও এ শুভ মুহূর্তে সেজভাইয়ের তাঁকে বিশেষ করে মনে পড়ল। তাঁর বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়ির মোড় ঘোরাল। এবার গাড়ি কারিগরি মিলনায়তনের কাছ দিয়ে অগ্রসর হতে লাগল। আরও এগোতে জনহীন রাস্তায় একগাড়ি সৈন্য দেখলাম। এরা কোন্ পক্ষের সৈন্য তা স্পষ্ট করে বুঝতে পারলাম না। তারা ইশারায় আমাদের এ রাস্তার সামনের দিকে অগ্রসর হতে বারণ করল। ভাই গাড়ির দিক পরিবর্তন করে রমনা পার্কের কাছ দিয়ে চলল, যেতে হবে টেনামেন্ট রোডে মুহম্মদ আলী সাহেবের বাসায়। তার পর তাঁকেসহ রেসকোর্সের ময়দানে। গাড়ি এপথ-ওপথ ঘুরে পৌঁছাল মুহম্মদ আলী সাহেবের বাড়ি। আমাদের দেখে তো মুহম্মদ আলী সাহেবের চোখ ছানাবড়া। নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছে। দেশ স্বাধীন, আমরা মুক্ত, এসব শুনে তিনি উল্লসিত হয়ে উঠলেন। সেখানে চা খেলাম। বাচ্চারা গলা খুলে জাতীয় সঙ্গীত ‘সোনার বাংলা...’ গাইল। গানের সুর আমাদের হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে যেয়ে ঘা দিল। আমরা আনন্দে বেদনায় বিহ্বল হলাম। তারপরে আবার রওনা হলাম রেসকোর্সের দিকে। গাড়ি এগিয়ে চলছে। দু’পাশে ঝোপঝাড়। হঠাৎ করে আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ করে একটা ‘পিকআপ’ এলো। তাতে ঢোলাঢালা কোর্তা-পায়জামা পরা বেশ কিছু অবাঙালী। দেখতে না দেখতে পিকআপকে অনুসরণ করে একটা জীপ কাছাকাছি আসতেই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। আমাদের গাড়ি মধ্যখানে, আর দু’দিকে গোলাগুলি চলতে লাগল। ভাই উপায় না দেখে তাড়াতাড়ি রাস্তায় পাশের একটা জনশূন্য বাড়ির গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল। গোলাগুলি থেমে গেলে তারপর বেরিয়ে এলাম। অতি সতর্কতার সঙ্গে সেই টেনামেন্ট রোডের দিকে ফিরে চললাম। মুহম্মদ আলী সাহেব এ পরিস্থিতিতে রেসকোর্সে যেতে বারণ করলেন। কারণ, পাকিস্তানী অনেক সৈন্যই তখনও আত্মসমর্পণের খবর জানত না। তারা পথে কাউকে দেখলেই গুলি করত। তাই বাড়ির পথে ফিরে চললাম। একটু এগোতেই দেখলাম। অবাঙালীদের সে পিকআপটি অকেজো হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। আশপাশের ঝোপঝাড়ের দিকে নজর পড়তে দেখলাম সেই ঢোলাঢালা পোশাক পরা দু’চারজন ঝোপের আড়ালে মেশিনগান হাতে পজিশন নিয়ে আছে। আর একটু এগোতেই দেখলাম গাছের কা-ে জনাকয়েক উস্কো-খুস্কো চুল, দাঁড়িওয়ালা মুক্তিযোদ্ধা তীক্ষè চোখে নিজদের পাতার আড়ালে রেখে কাদের যেন খুঁজছে। বোধকরি সেই অবাঙালীদের। আমাদের ভেতর অনুশোচনা হলো। কেন বের হলাম? বেলী রোডের দিকে এগোতেই দু’তিনজন করে লোক রাস্তায় দেখতে পেলাম আর এগোতেই খ- খ- দল দেখলাম। তারা জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে আমাদের স্বাগতম জানাল। আমরা একাত্মতার তীব্র স্পন্দনে শিহরিত হলাম। তারাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাদের বেলী রোডের দিকে এগোতে বারণ করল। কারণ, কিছুসংখ্যক পাকসৈন্য ওখানে লুকিয়ে ছিল। তারা যাকে দেখছিল তাকেই গুলি ছুড়ছিল। আমরা এপথ-ওপথ ঘুরে গুলিস্তানের কাছে আসতেই রাস্তায় দাঁড়ানো দু’জন লোক জয় বাংলা বলে হর্ষধ্বনি করে উঠল। তাঁদের এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তাঁরা জানালেন, এখানে দাঁড়িয়ে নবাবপুর অভিমুখের যাত্রীদের হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন। কারণ, পাকসেনা এখনও ওখানে পাহারারত। গত ন’মাসে প্রচুর লোক প্রাণ হারিয়েছে তাদের হাতে। এখন মুক্ত দেশে যাতে ওদের হাতে কেউ মারা না পড়ে তার জন্য এ নিরাপত্তার ব্যবস্থা তাঁরা নিয়েছেন। তাঁরা আমাদেরও ফুলবাড়িয়া স্টেশনের দিকে যেতে বারণ করলেন। আমরা অগত্যা জিপিওর কাছ দিয়ে তৎকালীন ডিপিআই (বর্তমানে শিক্ষা ভবন) অফিসের রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। মন শ্রদ্ধায় ভরে উঠল পাহারারত ভাইদের জন্য। এগোচ্ছি। মনে শঙ্কা। বাড়ি পৌঁছাতে পারব কিনা! আর একটু এগোতে ভূতপূর্ব বিএনআর অফিসের (বর্তমানে রেলওয়ে ভবন) সামনে যা দেখলাম, তাতে সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে শোকাভিভূত হয়ে পড়ল। সেই পতাকাধারী, যাঁকে যাওয়ার পথে মুক্তির আনন্দ মিছিলের অগ্রভাগে জয় বাংলা পতাকা হাতে এগিয়ে যেতে দেখেছিলামÑ তাঁর প্রাণহীন রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। তাঁর ডান হাতের মুঠিতে তখনও জয় বাংলার পতাকা ধরা। মনে মনে সালাম জানালাম মুক্ত বাংলার আমাদের দেখা প্রথম শহীদকে। স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে যেয়ে যিনি রক্ত ছড়ালেন রাজধানীর বুকে। যিনি ন’টি মাসের ভয়াবহ নারকীয় যুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে জপছিলেন একটি শুভ দিন। সে শুভ দিন এলো। সযতনে লুক্কায়িত প্রিয় পতাকা হাতে এগিয়ে এলেন মুক্তির ঘ্রাণ নিতে। হৃদয়বিদারক দৃশ্য মনে নিয়ে এগোচ্ছি। গাড়ি কার্জন হলের কাছে আসতেই আমাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ওমা কি! এত সৈন্য? ভারতীয় সৈন্য ভেবে সহৃদয়তায় হাত নাড়লাম, তাঁরাও হাত নাড়িয়ে জবাব দিল। কিন্তু যতই এগোচ্ছি ততই পোশাক-আশাক দেখে বুঝতে পারছি, এরা পাকসৈন্য। আত্মসমর্পণের জন্য রেসকোর্সের দিকে যাচ্ছে। দু’সারি সৈন্যের মাঝ দিয়ে অতি ধীরে আমাদের গাড়ি এগোচ্ছে। পেছনে ফেলে আসা হৃদয়বিদারক দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, এই বুঝি আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি। এই বুঝি এক ঝাঁক বুলেট এসে পাঁজরা ছিদ্র করে দিচ্ছে। শ্রান্ত-ক্লান্ত সৈন্যরা কেউ গোলাগুলির বাক্স মাথায়, কেউ কাঁধে মেশিনগান ঝুলিয়ে পায়ের পর পা ফেলে রাস্তার দু’পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে চলন্ত গাড়িতে আমরা ফাঁসির আসামির মতো মৃত্যুর প্রহর গুনছি। মুহূর্তের যুগ শেষ হচ্ছে। এভাবে আমরা তিন সেকেন্ডের রাস্তা দশ মিনিটে পার হলাম। দু’সারি সৈন্যের কবল থেকে বেরিয়ে আসার পর একটু এগোতেই আর এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। দু’জন পথচারী একে অপরের গায়ে রক্তাক্ত দেহ নিয়ে লুটিয়ে আছে। ক্ষণিক আগে যাদের মাঝ থেকে বেরিয়ে এসেছি তাদের নৃশংসতার চিহ্ন দেখে চোখ বেয়ে নেমে এলো লোনা পানি। স্বাধীন দেশের মুক্ত হাওয়া নিতে এঁরাও হয়েছেন শহীদ। মনে প্রশ্নের ঝড় এলো। পাক সেনারা আমাদের গুলি করল না কেন? গাড়িতে ছিলাম বলে? না বাচ্চাকাচ্চা সঙ্গে ছিল বলে? না আমরা মেয়েরা সঙ্গে ছিলাম বলে? সঠিক জবাব নিজেদের মনে মেলাতে পারলাম না। কারণ, পাক সেনাদের অত্যাচারের কাছে মা-বোন, শিশু কেউই রেহাই পায়নি। গাড়ি নিমতলীর গেটে এলো। যাওয়ার আগে যাদের জটলা পাকাতে দেখেছিলাম তারা তখনও দাঁড়িয়ে। গাড়ি কাছে আসতেই তারা শত প্রশ্নে আমাদের ঘিরে ধরল। মেলে ধরলাম অভিজ্ঞতার ডালি। ফিরে এলাম ঘরে। যাওয়ার সময় মনে নিয়ে গিয়েছিলাম মুক্তির উল্লাস আর মুক্ত ঢাকা দেখার অধীর বাসনাÑ কিন্তু ফিরে এলাম হৃদয়ের পটে এঁকে অচেনা ভাইদের রক্তাক্ত স্মৃতি। আজ ৪৩তম বিজয় দিবস। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ফেলে এসেছি অতীতের পাতায়। কিন্তু অতীত থেকে মুছে ফেলতে পারিনি সেই অপরিচিত বাঙালী ভাইদের রক্তাক্ত মুখ, যাঁরা স্বাধীন দেশের ঊষালগ্নে প্রাণ হারিয়েছেন। বিশেষ করে ভুলতে পারছিনে পতাকাধারী সে রক্তাক্ত ভাইয়ের চেহারা। সে সঙ্গে মনে পড়ছে অনেকের কথা, যাঁরা হারিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে। যাঁরা বিদায় নিয়েছেন আমাদের এ সুন্দর পৃথিবী থেকে বিজয় দিবসের দু’তিন দিন আগে আলবদরের হাতে। এমনি শত চেনা-জানা স্বজন-পরিজনের মুখ মনে পড়ছে। সে সঙ্গে চোখে অজান্তেই নেমে আসছে লোনা পানির ধারা। লেখক : গবেষক
×