ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সপ্তম ৫ সালা পরিকল্পনার লক্ষ্যই হচ্ছে দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা, দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা

ভিশন-২১ বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রস্তুত

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

ভিশন-২১ বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রস্তুত

এম শাহজাহান ॥ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ঐতিহাসিক বছর সামনে রেখে দেশের অর্থনৈতিক রূপরেখা তৈরি করছে সরকার। আর মাত্র ছয় বছর পর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে জাতি। এ লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছে ভিশন-২১ পরিকল্পনা। লক্ষ্য বাস্তবায়নে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। সরকার আশা করছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। প্রবৃদ্ধি হবে ৯ থেকে ১০ শতাংশ। দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পদক্ষেপ থাকছে। তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান হবে প্রথম। এজন্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির রোডম্যাপ গ্রহণ করা হয়েছে। জানা গেছে, সরকারের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে ভিশন-২১ বাস্তবায়ন। একই সঙ্গে ভিশন ২০৪১ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ওই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেই উদ্দেশ্যে সরকার একটি পারস্পেক্টিভ প্ল্যান (২০১০-২০২১) এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক প্ল্যান (২০১০-২০১৫) প্রণয়ন করে, লক্ষ্য হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই দেশকে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্পে এমন দীর্ঘমেয়াদী ও বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ নজিরবিহীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর ড. খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেই বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। একটি দেশ মধ্য আয়ের হতে হলে যে ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দরকার সেটা সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এ কারণে ভারতের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের চেয়েও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি গত কয়েক বছর ধরে ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তিনি বলেন, ৬ শতাংশের ওপরের প্রবৃদ্ধি যে কোন দেশ মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। এই স্বপ্ন পূরণ অসম্ভবও নয়। তাই সরকারের ভিশন-২১ পূরণ হবে। তবে এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও প্রয়োজন। গত বছর জাতীয় নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর দেশে কোন গ-গোল দেখা যায়নি। এই স্থিতিশীলতা কন্টিনিউ করলে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। তিনি বলেন, সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপের ফলে প্রাইভেট সেক্টর অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সরকারী খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতিও ভাল। তাই বলা যায় আমরা মধ্য আয়ের দেশ হতে যাচ্ছি। ভিশন-২১ সামনে রেখে ইতোমধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র তৈরি করছে সরকার। লক্ষ্য আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়া। এ উদ্দেশ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাতও ব্যাপক উদ্যোগে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ শুরু করতে যাচ্ছে। আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে এ সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা দেবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হরতাল-অবরোধের নামে গত বছরের পুরোটা সময় বিএনপি, জামায়াত-শিবির ও হেফাজত দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। ওই সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শিল্পের চাকা। কিন্তু সরকার ভিশন-২১ সামনে রেখে নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরেছে। শিল্পের চাকা সচল হয়ে কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে পাঁচ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র তৈরির কাজ শুরু করে। নির্দেশ অনুযায়ী কাজও শুরু করেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, গত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতায় হুমকির মুখে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করাই হবে বর্তমান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ভিশন-২১ বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতি পুুনরুদ্ধারে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। স্বল্প মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারী খাতকে উৎসাহ প্রদানের নীতি গ্রহণ এবং মধ্য মেয়াদে বড় বিনিয়োগ প্রকল্প নিয়ে তার যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর নজর দিতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) ॥ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যার্জনে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে জানানো হয়, ১৯৭২ সালে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বা এডিপির আকার ছিল ৫শ’ ১ কোটি টাকা, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮৬ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চলমান রয়েছে (২০১১-২০১৫)। এছাড়া বৈঠকে উন্নয়ন ধারার পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ’২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে এবং সরকারী বিনিয়োগের যথাযথ ফল অর্জনের জন্য কার্যক্রম বিভাগসহ পরিকল্পনা কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এদিকে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনে সাতটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলো হলো- দুর্বল অবকাঠামো, অর্থনৈতিক বহিমুখিতার অভাব, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, বন্দর সমস্যা, অদক্ষ শ্রমশক্তি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ, জনসংখ্যার চাপ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি। তবে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক গতিশীলতা ধরে রাখার জন্য বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষ জনবল ও রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের আরও কয়েক বছর লাগবে। আশা করছি ২০২১ সালের মধ্যেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে বাংলাদেশ। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে ৬২ লাখ ৪০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০ লাখের বেশি শ্রমিক রফতানি হয়েছে। সরকারের প্রণীত ষষ্ঠবার্ষিক পরিকল্পনায় এক কোটি লোকের কাজের সুযোগ তৈরির লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। অবশ্য জিইডির সদস্য ড. শামসুল আলম জানান, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে। তিনি বলেন, জাতীয় সঞ্চয় বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে এ হার আরও বেশি হবে। এই চিত্রই বলে দেয় বিনিয়োগে আমাদের সামর্থ্য আছে। কিন্তু সুযোগ ও পরিবেশের অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। জিডিপিতে কৃষির অবদান কমলেও বেড়েছে শিল্প খাতের। তিনি বলেন, এর অর্থ হচ্ছে অর্থনীতি ক্রমেই কৃষিনির্ভরতা থেকে শিল্প খাতের দিকে ধাবমান হচ্ছে, যা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক। জানা গেছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদী রোডম্যাপ প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ এবং ২০২১ সালের মধ্যে ৯-১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০২১ সালের মধ্যে ২ হাজার ডলারে উন্নীত করা, জাতীয় সঞ্চয় ২০২১ সালের মধ্যে মোট জিডিপির ৩৯ শতাংশ অর্জন করা, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ শতাংশ অর্জন এবং ২০২১ সালের মধ্যে দরিদ্রতা কমিয়ে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে ব্যাপক ভিত্তিতে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এজন্য দেশী-বিদেশী এমনকি প্রবাসীদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সবচেয়ে বেশি জরুরী। এই চ্যালেঞ্জ অর্জনে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিল্প-সভ্যতার ভিত্তি রচনার জন্য দেশী-বিদেশী এবং প্রবাসী বাঙালী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিনিয়োগ বাড়াতে ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে আইন ও বিধি সহজ করা, ওয়ানস্টপ সার্ভিস কার্যকর করা, কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমন, বিনিয়োগবান্ধব রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি, অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ, রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণ এবং বিনিয়োগকারীদের যুক্তিসম্মত রাজস্ব ও আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রণীত সমন্বিত শিল্পনীতি ও কৌশলপত্র ভবিষ্যতে আরও সময়োপযোগী করা হবে। এছাড়া পদ্মা সেতু-রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রসহ ছয় মেগা প্রকল্প সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে প্রথম পর্যায়ের (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকার আশা করছে ফাস্ট ট্র্র্যাকের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, ঢাকা গণপরিবহন উন্নয়ন প্রকল্প (মেট্রো রেল), কক্সবাজারে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে হলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে এসব কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
×