ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ীদের ৫৯ ঘর ও দোকানে প্রতিপক্ষের আগুন

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ীদের ৫৯ ঘর ও দোকানে প্রতিপক্ষের আগুন

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস/ নিজস্ব সংবাদদাতা, রাঙ্গামাটি ॥ রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে ভূমি নিয়ে বিরোধের জের হিসেবে বাঙালীদের আনারসের বাগান কেটে ধ্বংস করার ঘটনায় উত্তেজিত বাঙালীরা তিনটি গ্রামের ৫৭ বসতবাড়ি ও দোকানঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে বৌদ্ধ মূর্তি ভাংচুর ও লুট করার দাবি করা হলেও প্রশাসনের কোন সূত্র তা স্বীকার করেনি। তবে এক বৌদ্ধভিক্ষু সামান্য আক্রান্ত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার রাতে বাঙালীদের বাগান ধ্বংস ও মঙ্গলবার পাহাড়ীদের বসতবাড়ি ও দোকানে আগুনের ঘটনার প্রতিবাদে উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঘটনার পর জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সেনা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে উপজেলা পরিষদ চেয়রম্যানকে প্রধান করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্থানীয় লোকজন, সেনা, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সোমবার গভীর রাতে নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের বগাছড়ি এলাকার তিন বাঙালী আনারস চাষীর মালিকানার ১০ একর বাগানের সাড়ে ৩ লাখ আনারসের ফলন্ত চারা কেটে ধ্বংস করা হয়। যার মূল্য অর্ধকোটি টাকারও বেশি। মঙ্গলবার সকালে চাষীরা তাদের বাগানের এই অনাকাক্সিক্ষত দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়। ঘটনাটি দ্রুত জানাজানি হলে বাঙালী সম্প্রদায়ের লোকজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে । এই সময় বাঙালীদের উচ্ছৃঙ্খল লোকজন স্থানীয় পাহাড়ী পল্লীতে হামলা চালায়। জ্বালিয়ে দেয় তিন গ্রামের ৭টি দোকান ও ৫২টি বসতঘর। এই সময়ে ভীতসন্ত্রস্ত পাহাড়ীরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র স্থানে চলে য়ায়। ঘটনার খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত ঘটনার স্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনার প্রতিবাদে রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি সড়ক পাহাড়ীরা পাহাড়ীদের এলাকায় ও বাঙালীরা বাঙালীদের এলাকায় সড়ক অবরোধ সৃষ্টি করে। পাহাড়ীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নরিসেন তালুকদারপাড়া, শিয়াল্যাপাড়া, ১৪ মাইল এলাকাসহ তাদের ৩টি পাড়া এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পাড়াগুলোর ৭টি দোকানসহ ৫৯টি বসতঘর পুড়ে গেছে। অপরদিকে, বগাছড়ি এলাকার বাঙালী লোকজনের দাবি বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলা ১০ একর জমির ফলন্ত আনারসসহ সেগুন ও গামারি কাছের বাগান সম্পূর্ণ কেটে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এলাকার অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, আনারসের বাগান এলাকার জমি নিয়ে পাহাড়ী বাঙালীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ ছিল। এই বিরোধীয় জমিতে বাগান করায় দুর্বৃত্তরা রাতের আঁধারে এই বাগান কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। এ ব্যাপারে রাঙ্গামাটি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ভূমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে বলে অবহিত হয়েছেন। এ বিষয়ে মহিলা সংসদ জেএফ আনোয়ার চিনু জানান, বাগান ধ্বংস করার ঘটনা যেমন দুঃখজনক, তেমনি বাড়িঘর জ্বালাও-পোড়াও ঘটনাও দুঃখজনক। মঙ্গলবার জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার বিভাগের পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বগাছড়ির পুনর্বাসিত বাঙালীরা তিনটি জুম্ম গ্রাম সুরিদাশপাড়া, নবীনকারবারীপাড়া ও বগাছড়িতে এ হামলা চালিয়েছে। এতে বাড়িঘর পোড়ানো ছাড়াও এক বৌদ্ধভিক্ষু ও দুই পাহাড়ী আহত হয়েছেন। চৌদ্ধ মাইলের করুনা বৌদ্ধ বিহারের একটি বৌদ্ধমূর্তি ভাংচুর ও পাঁচটি পিতলের বৌদ্ধ মূর্তি লুট করে নিয়েছে উত্তেজিত বাঙালীরা। এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোঃ মোস্তফা কামাল, জেলা পুলিশ সুপার আমেনা বেগম, সেনাবাহিনীর নানিয়ারচর জোন কমান্ডার লে. কর্নেল সোহেল আহমেদ, মেজর জুলকার নাইন, জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ, নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা নানিয়ারচরের ওসি আবদুর রশিদসহ প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে দ্রুত ছুটে যান। সেখানে ঘটনার তদন্তে উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত করে ঘটনার বিষয়ে রিপোর্ট প্রদানের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে, এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে তাৎক্ষণিক সহায়তা হিসেবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। এছাড়া প্রতি পরিবারকে ১ বান করে ঢেউটিন, ২টি করে কম্বল প্রদান করা হয়। এ সংঘর্ষের ঘটনায় এলাকায় পাহাড়ী-বাঙালীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোঃ মোস্তফা কামাল। তিনি জানান, আনারস বাগান কেটে ফেলার ঘটনা নিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে তিনি জানান। তবে সব ধরনের সংঘাত এড়াতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে পুলিশ সুপার আমেনা বেগম জানান। নানিয়ারচর থানার ওসি আবদুর রশিদ বলেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত ৫৯টি পরিবারের তালিকা করেছেন। এ ব্যাপারে এখনও থানায় কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ দিলে মামলা নেয়া হবে।
×