ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয়ের ৪৪ বছরে পদার্পণ মঞ্চায়ন

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয়ের ৪৪ বছরে পদার্পণ মঞ্চায়ন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঘড়ির কাঁটায় তখন ৪টা ৩৩ মিনিট। রমনার রেসকোর্স ময়দানে হাজারো মানুষের ভিড়। ময়দানের পশ্চিমে আবির ছড়িয়ে হেলে পড়েছে শীতের সূর্য। সে আবিরের আলো অদ্ভুত দ্যুতিময়। হবে নাই বা কেন, এ আবিরের সঙ্গে যে মিশে আছে ৩০ লাখ শহীদের বিন্দু বিন্দু রক্তকণিকা! সমবেত জনতার চোখে মুখে তখন মুক্তির আনন্দ, বিজয়ের দৃপ্ত শপথ। এরই মধ্যে পরাজিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে সঙ্গে নিয়ে ময়দানে ঢোকেন মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সেনানায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। ময়দানে পাতা ছোট্ট টেবিলে বসে নতশিরে নিয়াজী সই করলেন আত্মসমর্পণ দলিলে। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বেল্ট থেকে অস্ত্র খুলে সমর্পণ করলেন জেনারেল অরোরার কাছে। সৃষ্টি হলো ইতিহাস। বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নিল নতুন একটি স্বাধীন দেশ- বাংলাদেশ। বিজয়ের ৪৩তম বার্ষিকীতে মঙ্গলবার ঠিক এভাবেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাহেন্দ্রক্ষণটিকে প্রতীকী মঞ্চায়নে তুলে ধরে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভের মূল বেদিতে আয়োজিত এই প্রতীকী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সাক্ষী তখন এ প্রজন্মের হাজারো সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা ফিরিয়ে আনে একাত্তরের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্মৃতি। সেই স্মৃতি এতটাই বাস্তব হয়ে উঠল যে, নিয়াজীর অস্ত্র সমর্পণের পর পর গোটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রকম্পিত হলো জয়বাংলা সেøাগানে। মঞ্চায়ন শেষ হলেও ‘জয় বাংলা’ সেøাগান অনুরণিত হচ্ছিল লাখো কণ্ঠে। পুরো অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারী টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করে। ২০০৮ সাল থেকেই বিজয় দিবসে ‘পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের’ বার্ষিকী উদযাপন করে আসছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১। এ আয়োজন এবার পা দিল সপ্তম বছরে। আয়োজক সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ বললেন, নতুন প্রজন্মকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম মুহূর্তটি মনে করিয়ে দিতেই এ আয়োজন। পাশাপাশি তরুণরা যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে লালন করে স্বাধীনতার শত্রু ও দেশের শত্রুদের চিনতে পারে সেটাই এ আয়োজনের মূল লক্ষ্য। তার অংশ হিসেবেই অনুষ্ঠানের একটি অংশে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরের কমান্ডার ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা এ প্রজন্মের ২৭ তরুণের হাতে জাতীয় পতাকা হস্তান্তর করেন। ম. হামিদ বলেন, ‘এবারে বিজয় দিবস ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। গত বছর মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত মাত্র একজনের বিচার ও রায় কার্যকর হয়েছিল। এবার বেশ কয়েকজনের চূড়ান্ত রায় ও রায় কার্যকরের অপেক্ষায় আছে। গোটা জাতি তাদের রায় কার্যকর দেখতে চায়। অনুষ্ঠানের মূল বক্তা আয়োজক সংগঠনের চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে আমার ২৩ বছর ছিলাম। এই ২৩ বছরে পাকিস্তানীরা বাঙালীদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। একাত্তরের ৭ মার্চ এই মাঠেই বঙ্গবন্ধু স¦াধীনতার দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরাও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তাদের কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে হয়েছে জোর করে। দেশ শত্রুমুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে জানতে পারলেন, এ দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার যুদ্ধের সময় ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছে। দালাল আইনে বঙ্গবন্ধু তাদের বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই ধারবাহিকতায় বর্তমান সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করেছে। কয়েকটি রায় কার্যকরও হয়েছে। বাংলার মাটিতে একে একে সব রাজাকারের বিচারের রায় কার্যকর হবে ইনশাআল্লাহ।’ এ সময় তার পাশে ছিলেন সংগঠনের ভাইস চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী। এর আগে বিকেল সাড়ে তিনটায় আয়োজক সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবিবের সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর এক ঝাঁক শিশুশিল্পী দরদী কণ্ঠে পরিবেশন করে গান, ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি। ও আমার বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভূমি।’ বেদির সামনে উপস্থিত হাজারো মানুষ তখন মগ্ন। এরপর ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন একদল শিল্পী। ‘সম্ভাবনার বাংলাদেশ’ শীর্ষক আবৃত্তির কোরিওগ্রাফির দলগত উপস্থাপনা ছিল দৃষ্টিনন্দন। এরপর কবিতার কথামালার সঙ্গে মিলিয়ে মোহনীয় ভঙ্গিতে শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের চিত্র। সেখানে ছিল ক্রিকেটে বাংলাদেশের গৌরবগাথা, হিমালয় জয়, পাটের জিন আবিষ্কার, সমুদ্র বিজয়ের শিল্পীত উপস্থাপনা। উপস্থিত জনতা পরিবেশনার জবাব দেয় বিপুল করতালির মাধ্যমে। এরপরই মঞ্চস্থ হয় অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আকর্ষণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় ‘পাকি হানাদার বাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের’ নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয়। মিনিট পাঁচেকের এই পরিবেশনা জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দেয় একাত্তরের আবেগ। এরপর হয় বক্তৃতা পর্ব। বক্তব্য দেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান ও এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল কেএম. সফিউল্লাহ, বীর উত্তম। তার বক্তব্যের পর পরই জাতীয় পতাকা হাতে সারি বেঁধে একে এক মঞ্চে আসেন ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের বীরত্বের গৌরব হস্তান্তর করেন উত্তরাধিকারী এ প্রজন্মের ২৭ তরুণের হাতে। এরপর ছিল আরও কয়েকটি গান, কবিতা ও নৃত্যের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বিকেল পাঁচটায় শেষ হয় অনুষ্ঠান।
×