ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পেশোয়ারে আর্মি পাবলিক স্কুলে ঢুকে শতাধিক ছাত্র হত্যা ॥ তালেবানী হত্যাযজ্ঞ

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

পেশোয়ারে আর্মি পাবলিক স্কুলে ঢুকে শতাধিক ছাত্র হত্যা ॥ তালেবানী হত্যাযজ্ঞ

আফজাল হোসেন ॥ পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে তালেবান জঙ্গীদের সঙ্গে ৯ ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর জিম্মি উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে সেনাবাহিনী। সেনা কর্মকর্তারা জানান, উদ্ধার অভিযান শেষ। সাত জঙ্গী নিহত হয়েছে। তবে সেনাবাহিনী বোমার খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সেনা সূত্র ৯ জঙ্গী নিহত হওয়ার কথা জানায়। অভিযানে সাত সেনা আহত হয়েছে বলে রয়টার্স জানায়। সকালে তালেবান জঙ্গীরা স্কুলে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালায়। এই নৃশংস হামলায় শতাধিক ক্ষুদে শিক্ষার্থী নিহত হয়। আহত হয় আরও শতাধিক শিক্ষার্থী। সর্বশেষ খবরে বলা হয় ১৪১ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৩২ জনই ক্ষুদে ছাত্র। আহতদের বেশিরভাগ ছাত্রের অবস্থাই গুরুতর বলে স্থানীয় সামরিক হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। আহতদের মধ্যে কয়েক শিক্ষকও রয়েছেন। পেশোয়ারের ওয়ারসাক রোডের ওই বিদ্যালয়ে ঢুকেই তালেবান জঙ্গীরা প্রায় ৫শ’ ছাত্র-শিক্ষককে জিম্মি করে। এ সময় জঙ্গীরা সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ছিল। তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) মুখপাত্র মুহাম্মদ খোরাসানি হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে বলেন, এতে ছয় জঙ্গী অংশ নিয়েছে। তবে সেনাবাহিনী জানায়, হামলায় আট থেকে ১০ জন অংশ নেয়। রাতে তেহরিক-ই-ইনসাফ মুখপাত্র শিরীন মাজারি এ ঘটনায় ১৪৬ জনের নিহত হওয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, এর মধ্যে ১৪০ জনই শিশু ছাত্র। হামলায় আরও ১১৩ জন আহত হয়েছে। খবর এএফপি, বিবিসি ও ডন অনলাইনের। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেইন ও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে আর্মি পাবলিক স্কুলের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তিনি এ ঘটনায় দেশব্যাপী তিন দিনের শোক পালনের ঘোষণা দেন। ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ পেশোয়ারে সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করেছেন। আজ বেলা সাড়ে এগারোটায় প্রাদেশিক গবর্নর হাউসে এ সম্মেলন হবে। সম্মেলনে সকল সংসদীয় দলের নেতৃবৃন্দ অংশ নেবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্বরোচিত এ হামলার ঘটনায় পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছে। এ সময় একজন সন্ত্রাসী জীবিত থাকলেও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করা হয়। বিদ্যালয়ে হামলা এবং শতাধিক নিহতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড ওলসন এ ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং নিহতদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি সমবেদনা জানান। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরাও ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। পাকিস্তান তেহরিক-ই- ইনসাফ (পিটিআই) ন্যক্কারজনক এ হামলার পর দেশব্যাপী ১৮ ডিসেম্বরের বিক্ষোভ কর্মসূচী স্থগিত করেছে। পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক (পিএটি) তাদের (আজকের) কর্মসূচী স্থগিত করে। বিদ্যালয়ে হামলার পর সরকারের সঙ্গে পিটিআইর আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে। এএনপির গুলাম আহমেদ বিলাওয়াল ঘটনার জন্য প্রাদেশিক সরকারকে দোষারোপ করেন এবং তারা ‘সম্পূর্ণ ব্যর্থ’ বলে আখ্যায়িত করেন। পিটিআই নেতা শাহ মাহমুদ কোরেশী বলেন, এ ঘটনার জন্য প্রাদেশিক সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তবে সমালোচনা সব কিছুর সমাধান নয়। তিনি সমালোচনা না করে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। পিটিআইপ্রধান ইমরান খান খাইবার পাখতুনখোয়ার গবর্নর পারভেজ খাত্তাককে দ্রুত ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। টিটিপির এক মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেন, উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সেনা অভিযানের প্রতিশোধ নিতে এ হামলা চালানো হয়েছে। খবরে বলা হয়, ছয় জঙ্গী তালেবান সামরিক পোশাকে পেশোয়ারের ওয়ারসাক রোডে আর্মি পাবলিক স্কুলের নিরাপত্তা বেষ্টনী কেটে স্কুলে ঢোকে। খবর পেয়ে নিরাপত্তা বাহিনী স্কুলের দিকে অগ্রসর হলে বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। গুলি ও আত্মঘাতী বোমা হামলায় সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ১৪১ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে কমপক্ষে ১৩২ জনই শিশু। হামলায় একজন সেনাসদস্যও নিহত হয়। সেনাবাহিনী জানায়, অভিযানে ছয় জঙ্গী নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহত শিক্ষার্থীদের বয়স ১০ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে এবং তারা সেনা কর্মকর্তাদের সন্তান। স্কুলটির এক কর্মী জানায়, জঙ্গীরা যখন স্কুলে ঢোকে তখন স্কুল মিলনায়তনে সেনাবাহিনীর একটি দল শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। জঙ্গীরা স্কুল ভবনে ঢুকেই কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। হামলার সময় কমপক্ষে ১৫টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। আইএসপিআর জানায়, বিদ্যালয়ের শেষ ভবনটি থেকে ষষ্ঠ জঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় দু’জন ছাত্র এবং কয়েক শিক্ষককে উদ্ধার করা হয়। জঙ্গীরা অবশ্য বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ আইইডি দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এর ফলে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে কিছুটা সমস্যা হয়। প্রাদেশিক তথ্যমন্ত্রী মুশতাক গনি বিকেলে এএফপিকে বলেন, মৃতের সংখ্যা ১৩১ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া শতাধিক আহত হয়েছে বলে জানান তিনি। মৃতের এ সংখ্যা আরেক মন্ত্রীও নিশ্চিত করেন। তালেবানের এক মুখপাত্র বলেন, উত্তর ওয়াজিরিস্তান ও খাইবার উপত্যকায় সামরিক বাহিনীর অভিযানের জবাবেই তাদের এই হামলা। সম্প্রতি ওই দুটি এলাকায় জঙ্গী দমনে সেনা অভিযানে কয়েক হাজার তালেবান নিহত হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের । এদিকে তেহরিক-ই-তালেবান (টিটিপি) মুখপাত্র মোহাম্মদ খোরাসানি এই হামলার দায় স্বীকার করে বলেন, দলে মোট ছয় হামলাকারী রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা অপেক্ষাকৃত বড় শিক্ষার্থী এবং সেনা সদস্যদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল, শিশুদের নয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ মঙ্গলবারের হামলার ঘটনাকে কাপুরুষোচিত আখ্যা দিয়ে এর সঙ্গে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তির কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে পাঠানো এক বার্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর স্থানীয় সকল সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। স্কুলের সকল শিশু এবং নিরীহ লোকদের নিরাপদে বের করে আনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ পেশোয়ারে সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী জর্ব-ই-আজব অভিযান শুরু করেছে। দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ নিপাত না যাওয়া পর্যন্ত তা চলবে। এ ব্যাপারে আফগানিস্তানের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং আমরা একসঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। পেশোয়ারে পৌঁছে নওয়াজ শরীফ এ হামলার ঘটনায় দেশব্যাপী তিন দিনের শোক ঘোষণা করেন। পরে তিনি পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। আজ বেলা সাড়ে এগারোটায় গবর্নর হাউসে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাসের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, শিশু ও শিক্ষকদের ওপর অমানবিক ও বিবেকবর্জিত হামলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তীব্র নিন্দা এবং পাকিস্তানের নাগরিকদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছে। আমরা সবাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। পাশাপাশি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির সিরাজুল হকও এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। এক টুইটার পোস্টে তিনি বলেন, ধর্মের নামে শিশু হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। ওবামার নিন্দা ॥ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ছাত্র-শিক্ষকের ওপর ঘৃণ্য হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা আবারও বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান সরকারের প্রতি ওবামা তাঁর সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিন্দা ॥ বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেশোয়ারে তালেবানদের হামলায় শতাধিক স্কুল ছাত্রসহ নিরস্ত্র বেসামরিক বহু মানুষকে হত্যার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সোমবার এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ বর্বর ও ন্যক্কারজনক হত্যাকা- সারা বিশ্বের মানুষকে শোকাহত ও স্তম্ভিত করেছে। তিনি এ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তিরোধে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হামলায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। খালেদার নিন্দা ॥ পাকিস্তানে তালেবানী হত্যাযজ্ঞে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার রাতে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, তালেবানের এ ধরনের হিংস্রতা বিশ্বের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অশান্ত করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। ধর্মের নামে অসহায় ও নিরীহ শিশু-কিশোরদের ওপর এ ধরনের হামলা ও পৈশাচিক হত্যাকা- সমগ্র বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত করেছে। বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেন, শিক্ষার্থীদের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। তিনি নিহত শিক্ষার্থীদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাদের স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানান। অপর বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তালেবান বরাবরই একটি নিপীড়ক শক্তি। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা পেশোয়ারে যে নির্মম হত্যাকা- ঘটিয়েছে তা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে চিরকাল ধিকৃৃত হয়ে থাকবে।
×