ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি-জামায়াতের সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলার ঘোষণা

আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য শোডাউন- বিজয় র‌্যালিতে লাখো মানুষ

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য শোডাউন- বিজয় র‌্যালিতে লাখো মানুষ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিজয়ের তেতাল্লিশ বছর পূর্তির দিন মঙ্গলবার রাজধানীতে মানুষের স্রোত নামিয়ে বড় ধরনের শো-ডাউন করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের হুমকির জবাবে বিশাল এই শো-ডাউনের মাধ্যমে সাংগঠনিক শক্তিরও মহড়া দিয়েছে দলটি। মহান বিজয় দিবসে ‘ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ৩২ নম্বর ধানম-ি’Ñ দীর্ঘ প্রায় তিন কিলোমিটার পথে আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা বিজয় র‌্যালিতে নেমেছিল লাখো মানুষের ঢল। পুরো রাজধানীই যেন পরিণত হয়েছিল মিছিলে নগরীতে। আর বিজয়পূর্ব বিশাল সমাবেশ থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে থেকেই বিএনপি-জামায়াতের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলার ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় নেতারা। লাখো মানুষের সমাগম। মাথায় লাল সবুজের পতাকা। বুকে দেশপ্রেম। গালে আঁকা মানচিত্র খচিত পতাকা। সবার চোখে-মুখে ছিল বিজয়ের তৃপ্তি। এ যেন একাত্তরের পরে আরও একটি বিজয়। চারদিকের মাইকের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ধ্বনি। দূর-দূরান্ত থেকে জয় বাংলা সেøাগান তুলে বাস-ট্রাকে চড়ে এসেছে বিজয়-আনন্দে উচ্ছল মানুষ। কোন ট্রাকে আবার বানানো হয়েছে বিজয় মঞ্চ। কোনটাতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা, কাগজের কামান, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাজাকারের আত্মসমর্পণের দৃশ্যও উঠে এসেছে কোথাও কোথাও। যুদ্ধাপরাধের বিচারের অঙ্গীকার, রায় বাস্তবায়ন আর রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীমুক্ত বাংলা গড়ার প্রত্যয়ের এ বিজয় মিছিল শেষ হওয়ার কথা ধানম-ির বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে, যখন সেখানে পৌঁছে একটি মুখ, তখনও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বের হতে পারেনি মিছিলের অন্য প্রান্ত, হাজারো মুখ। মাঝখানে মিছিলের ব্যাপ্তী ছিল তাবত রাজধানী জুড়ে। এ মিছিলের শুরু আছে শেষ নেই। বলা চলে বিজয়ের আলপনায় বর্ণিল সাজে গোটা রাজধানীই ছিল জয় বাংলা মুখরিত। ঢাকা মহানগরীর ১৫টি নির্বাচনী এলাকা, ৪১টি থানা এবং শতাধিক ওয়ার্ড থেকে অজস্র মিছিলের স্রোত এসে মিশেছিল ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে। তেতাল্লিশ বছর আগে ৪টা ২২ মিনিটে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের যে স্থানে পাক হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিল, ঠিক সেই সময় বিজয়ী লাখো বাঙালীকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা শিখা চিরন্তনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মাধ্যমে এ বিজয় র‌্যালির উদ্বোধন করেন। সুশৃঙ্খল-দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল এই বিজয় র‌্যালিতে জাতীয় নেতাদের কণ্ঠেও ছিল একই শপথ- ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, এখন রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’ নেতাদের এমন দৃপ্ত ঘোষণায় বিজয় র‌্যালিতে আসা হাজার হাজার মানুষের উল্লাস ও হর্ষধ্বনী সবার দৃষ্টি কাড়ে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিজয় র‌্যালি শুরু হয়ে শাহবাগ, কাঁটাবন, বাটার মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, সাইন্স ল্যাবরেটরি, মিরপুর রোড হয়ে ধানম-ির ৩২ নম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে এসে শেষ হয়। বিজয় র‌্যালিতে এমনই মানুষের স্রোত নেমেছিল যে, মিছিলের অগ্রভাগ যখন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে পৌঁছায়, পশ্চাৎভাগ তখনও শাহবাগ পার হতে পারেনি। প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই বিজয় র‌্যালিতে অংশ নেয়া সকল মানুষের কণ্ঠেই ছিল একই দাবি- ‘মুজিবের বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নেই, দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই।’ বিজয় র‌্যালির শুরুর আগে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে জনস্রোতের সামনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, জনবিচ্ছিন্ন খালেদা জিয়া আন্দোলনের হুঙ্কার দেন! ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও ঢাকাবাসীকে ডাক দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই ডাকে তাঁর কাজের বুয়া ছাড়া আর কেউ আসেনি। আগামীতেও আসবে না। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পর খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন নিয়াজী তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পরাজিত নিয়াজী তাঁকে ফেলে রেখেই চলে গেছেন। তিনি বলেন, যারা কোরান শরীফে আগুন দেয়, মসজিদে আগুন দেয়Ñ তাদের নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সেখানেও উনি ব্যর্থ হয়েছেন। ভেবেছিলেন ভারতে মোদি সরকার আসলে তাঁকে গদিতে বসাবে, কিন্তু বসায়নি। শুধু ভারত নয়, এখন গোটা বিশ্বই শেখ হাসিনার সঙ্গে রয়েছেন। শেখ হাসিনার কোন বিদেশী প্রভূ নেই, বন্ধু আছে। জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করেই শেখ হাসিনা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এগিয়ে যাবেই। যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, লাখো মানুষের স্রোত দেখে যান, রাজপথে আপনাকে আর পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের মোকাবেলা করতে প্রস্তুত আওয়ামী লীগ। মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ নাকি হায়েনার মতো আক্রমণ করছে! বাস্তবে মির্জা ফখরুলের দোসররাই একাত্তরে বাঙালীর ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষকে হত্যা করেছে, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থেকে ৫ বছরে ২৬ হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। নিজেরা হায়েনা বলেই অন্যকে তা বলতে চায়। আর খালেদা জিয়া আন্দোলনের হুঙ্কার দেন, আওয়ামী লীগ দেখিয়ে দেবে আন্দোলন কত প্রকার ও কী কী। ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ও তাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজপথে থেকেই মোকাবেলা করা হবে ইনশাল্লাহ। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম বলেন, আগামীতে খালেদা জিয়ার খবর আছে। রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের কোটি কোটি নেতাকর্মী, সমর্থক প্রস্তুত। এখনও সময় আছে খালেদা জিয়াকে রাজাকারদের সঙ্গে ঘর-সংসার বন্ধ করতে হবে। নইলে ঢাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা হবে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে খোলা ট্রাকের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ আজিজ। আরও বক্তব্য রাখেন এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি, ফয়েজ উদ্দিন মিয়া, যুব লীগের মজিবুল হক চৌধুরী, শ্রমিক লীগের ফজলুল হক মন্টু, স্বেচ্ছাসেবক লীগের পংকজ দেবনাথ এমপি, যুব মহিলা লীগের নাজমা আখতার, ছাত্রলীগের এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগসহ নগর নেতৃবৃন্দ। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে একাত্তরের রণাঙ্গণের সেই অমিততেজী গগনবিদারী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে বিজয় র‌্যালি শুরু হয়। আয়োজক ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ হলেও এ বিজয় র‌্যালিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। সুবিশাল এ বিজয় র‌্যালিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী, সমর্থক ও মুক্তিবুদ্ধি চর্চার অসংখ্য সাধারণ মানুষকে সুদীর্ঘ এ বিজয় র‌্যালিতে অংশ নিতে দেখা যায়। বিজয় র‌্যালিতে নারীদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখ করার মতো। একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং ৭ মার্চে স্বাধীনতার ডাক দেয়া বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকঠিন ঐতিহাসিক ভাষণের স্মৃতিবিজড়িত সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে দুপুর থেকেই মানুষের ঢল নামে। রাজধানীর ১০০টি ওয়ার্ড ও ৪১টি থানা থেকে অসংখ্য মিছিল আসতে শুরু করে সেখানে। বিকেল ৩টা বাজার আগেই শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তায় মানুষের তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাদ্য-বাজনার তালে তালে নেচে গেয়ে আসা তীব্র জনস্রোতে পুরো এলাকায় রীতিমতো মহাসমাবেশের রূপ নেয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর ১৫টি নির্বাচনী এলাকা থেকে দলের সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে বিশাল বিশাল দৃষ্টিনন্দন র‌্যালি সবার দৃষ্টি কাড়ে। এসব বর্ণাঢ্য র‌্যালিতে রং-বেরঙের বেলুন, ব্যানার, প্লাকার্ড, ফেস্টুন, ট্রাক, হাতি, ঘোড়ার গাড়ি, নৌকা, দলীয় ও জাতীয় পতাকা, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বিশাল বিশাল প্রতিকৃতিসহ বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে ব্যান্ডের তালে তালে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থক ছাড়াও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নগরীর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিজয় র‌্যালিতে ড্যামি রাইফেল, কামান, ট্যাঙ্কসহ মুক্তযুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের রণসজ্জা, পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের আত্মসমর্পণ, প্রতীকী ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের গোলাম আযম গংদের দ- কার্যকরের দৃশ্য, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় উল্লাসসহ বিভিন্ন ড্যামি প্রদর্শনী সাধারণ মানুষের বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ করে। র‌্যালিতে থাকা বিভিন্ন ট্রাকে লাগানো মাইকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করা হয়। সুবিশাল এ বিজয় র‌্যালির কারণে রাজধানীতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের।
×