ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

হারিয়ে যাচ্ছে শহীদ স্মৃতি

নিশ্চিহ্ন হচ্ছে গণকবর বধ্যভূমি

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

নিশ্চিহ্ন হচ্ছে গণকবর বধ্যভূমি

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরিয়ে ৪৩ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে দেশের ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। হানাদারবাহিনীর নৃশংসতার শিকার এসব শহীদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানও যথার্থভাবে হয়নি। মাটিতে গর্ত করে হানাদাররা নিহতদের লাশ পুঁতে ফেলেছে। বিজয়ের পর সেসব স্থানকেই বলা হয় গণকবর। স্বাধীনতার পর সেসব শহীদের গণকবর অবহেলার শিকার হয়ে চলেছে। সংরক্ষণ না করায় ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত শেরপুরের সংগ্রাম পরিষদ ভবনও সমান অযতেœর শিকার। ময়মনসিংহ, মুন্সীগঞ্জ, গাইবান্ধা ও শেরপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার এবং নিজস্ব সংবাদদাতার পাঠানো খবর: ময়মনসিংহ ॥ একাত্তরে শহরের ছোটবাজার কুয়ার ভেতরে পড়েছিল অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশুর পচা ও অর্ধগলিত লাশ। পরিত্যক্ত কুয়ার ভেতর থেকে লাশের গন্ধ ভেসে আসছিল। রাজাকার, আলবদর ও অবাঙালী বিহারী কিলাররা মুক্তিকামী বাঙালীদের ধরে এনে হত্যার পর লাশ ফেলে দিত ছোটবাজারের এই কুয়ার ভেতরে। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধা-জনতা যখন শহরজুড়ে হারানো স্বজনদের খুঁজতে বের হয় তখনই সন্ধান মেলে কুয়ার ভেতরে অসংখ্য লাশ স্তূপাকারে পড়ে থাকা এই বধ্যভূমিটির। অথচ সংরক্ষণ না করে ভয়াল স্মৃতির সেই কুয়ার চিহ্নহ্নটি মুছে ফেলা হয়েছে। গত ওয়ান- ইলেভেনের সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এ নিয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটিও আর আলোর মুখ দেখেনি। ছোটবাজারের কুয়ার ওপর গড়ে তোলা ইসলামী ব্যাংক ভবন অপসারণ করে স্মৃতি চিহ্নহ্নটি সংরক্ষণের দাবি উঠেছে। মুন্সীগঞ্জ ॥ মুন্সীগঞ্জে স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্বগাথা অনেক স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের অভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। আর বধ্যভূমিগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও। অসংখ্য বদ্ধভূমি রয়েছে ঢাকার কাছের এই অঞ্চলটিতে। মুন্সীগঞ্জ জেলা তথা এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি গজারিয়া গোসাইরচর বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমিতে চিরনিদ্রায় অসংখ্য শহীদ। শহীদ পরিবারের সদস্য ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা এমপির উদ্যোগে শহীদদের নাম খচিত একটি স্তম্ভ ছাড়া তাদের সম্মানে এখানে তেমন কিছু হয়নি। এছাড়াও শহরের হরগঙ্গা কলেজের পূর্বপাশের বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সদর উপজেলার সাতানিখিল বধ্যভূমি, টঙ্গীবাড়ি উপজেলার পালবাড়ি বধ্যভূমিসহ জেলার বিভিন্নস্থানে রয়েছে অসংখ্য বধ্যভূমি। গাইবান্ধা ॥ ১৯৭১ সালের পাক হানাদার বাহিনী, আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের হাতে নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞের একমাত্র কালের সাক্ষী গোয়ালেরঘাট বধ্যভূমি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪২ বছর অতিবাহিত হলেও সংস্কার ও মেরামত করা হয়নি এই বধ্যভূমি। অযতœ, অবহেলায় দিন দিন বধ্যভূমিটি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। একদিকে তিস্তার কড়ালগ্রাসে বিলীন হয়েছে বধ্যভূমির একাংশ। অপরদিকে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি না থাকায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালায় ঢেকে যাচ্ছে দৃশ্যপট। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোটা সুন্দরগঞ্জ উপজেলা, পাশাপাশি কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী ও উলিপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাক হানাদার বাহিনী নিরীহ মা-বোনদের ধরে নিয়ে এসে সম্ভ্রমহানি করে নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে লাশ ফেলে রাখে ওই গোয়ালেরঘাট বধ্যভূমিতে। লাশের স্তূপে পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমি এলাকা। শেরপুর ॥ সরকার যখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত ভবন, স্থাপনা, বধ্যভূমি ও স্মারকসমূহ সংরক্ষণে সচেষ্ট, ঠিক তখন শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহনকারী সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ভবনটি পড়ে রয়েছে অযতœ-অবহেলায়। কেবল তাই নয়, রক্ষককূলের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে একশ্রেণীর সরকারী কর্মচারীরা ভবনটি এখন বেদখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সচেতন মহল। জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই শেরপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র কালীরবাজার (বটতলা) মহল্লাস্থ তৎকালীন আবাসিক ম্যাজিস্ট্রেটের পরিত্যক্ত বাসভবনটি ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনার সাক্ষী ওই ভবনটি স্বাধীনতার পর অনেককাল ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ওই অবস্থায় ২০০৯ সালে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মুহম্মদ মুহসীন আলী মাস্টার ও প্রয়াত ভাষাসৈনিক-মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আব্দুর রশীদ বর্তমান জেলা প্রশাসকের বাংলোর পেছনে অবস্থিত অনাদরে অবহেলায় পড়ে থাকা ভবনটি উদ্ধারে এগিয়ে যান। তারা ভবনটি শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাদের ওই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন ও তহবিলও সংগ্রহ করা হয়। ২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ নাসিরুজ্জামান সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ভবনটি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর হিসেবে উদ্বোধন করেন। কমিটির পক্ষ থেকে ভূমিসহ ভবনটি দীর্ঘ মেয়াদের জন্য লিজের আবেদন জানান। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছরেও ওই বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন সাড়া মেলেনি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহনকারী ভবন সংরক্ষণের মহতী উদ্যোগটি স্থবির হয়ে যায়।
×