ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশ গুপ্ত

স্মৃতিসত্তায় উজ্জ্বল বিজয় দিবস

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪

স্মৃতিসত্তায় উজ্জ্বল বিজয় দিবস

আজ আমার খুব মনে পড়ছে ব্রুস উইলসনের কথা। তিনি তখন বিলেতের এক হাসপাতালে রোগশয্যায়। আমাদের এই দেশ অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাকি পৃথিবীর সময় মেলানো কঠিন। ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, শেখানো হয়েছিল, জাপান নাকি সূর্যোদয়ের দেশ। জানি না কোন্ অর্থে। ধরে নিতে পারি, সেখানে সূর্য প্রথম উদিত হয়, দেখা যায় বলেই তা বলা হয়েছিল। অঞ্চলভেঙ্গে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করে না দেখা এ তথ্য ঠিক নয়। জাপানের কয়েক ঘণ্টা আগে সিডনি আর সিডনিরও ঘণ্টাতিনেক আগে নিউজিল্যান্ডে সূর্য ওঠে। আমাদের যখন ভোর হয়, পৃথিবীর মানুষ তখন নিদ্রামগ্ন। কোথাও রাত বাড়ছে। সব মিলিয়ে সময় মেলানো কঠিন। তারপরও ঘড়ি মিলিয়ে ব্রুস উইলসনের খোঁজে ফোন লাগাতে যে কণ্ঠটি ভেসে এসেছিল তার স্মৃতি ভোলা যায় না। কথায় কথায় সে রাতে উদ্ভাসিত বিজয় দিবসের ঘটনা আমার মতো নগণ্য বাঙালীর জন্য দুর্লভ। ব্রুস উইলসন মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকটায় কলকাতায় ছিলেন। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর দ্বারা স্বাধীন দেশে নিউজ কভার করতে ঢুকে পড়েছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাত্তরের ষোলো ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জীবন্ত সাক্ষী ব্রুস উইলসন আবেগ থরথর কণ্ঠে বলেছিলেন রোমাঞ্চকর সে আসন্ন সন্ধ্যার বিজয়। আমি তখন স্তব্ধ। একজন বিদেশীর স্বপ্ন ও স্মৃতিতে জাগরূক বাংলাদেশের জন্মলগ্ন এভাবে শোনার অভিজ্ঞতা তুলনারহিত। কোন ঘটনাই ভুলেননি তিনি। যেসব ঘটনা স্মৃতির ধূলিতে কিঞ্চিৎ ধূসর সে সবে এ কে খন্দকারের রেফারেন্স টানছিলেন। জানি না, আজ আর তিনি জীবিত আছেন কিনা! মিডিয়া জগতের দুঁদে সাংবাদিক মেলবোর্ন এ কাগজের এই মানুষটির মতো অনেক বিদেশী তাঁদের জীবনের পরম সম্পদ বিবেচনা করলেও আমরা বিজয় দিবসকে ঠিক সেভাবে মনে রাখিনি। আমাদের ইতিহাস ও অতীত গর্বের জায়গাকে বারংবার হয় কলঙ্কিত, নয়তবা দ্বন্দ্বে ফেলে মজা দেখতে অভ্যস্ত। একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে রাইফেলের সঙ্গিন উঁচিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাবেশে জয়ী ওডারল্যান্ডকেও মনে রাখার কাজটি নগণ্য। আজ যখন এ লেখা লিখছি তাঁর কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ভয়ানক অসুস্থ, দৃষ্টিশক্তি হারানো বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড এখন শেষশয্যায়। স্নায়বিক উত্তেজনা বা টেনশন একেবারেই নিষিদ্ধ। তারপরও কয়েকবার চেষ্টা করার পর কথা বলার অনুমতি মিলেছিল। তাঁর সঙ্গে আলাপে এমন কিছু বলা যাবে না বা জানতে চাওয়া যাবে না, যাতে ওডারল্যান্ডের মনোসংযোগ বা চিন্তায় ঢেউ জাগে। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, ওসমানী আর বাংলাদেশ এই সত্তা ও অস্তিত্ব প্রয়াত এই বীরপ্রতীকের রক্ত কণায় ঠাঁই করে নিয়েছিল। আমাদের হয়ে লড়েছিলেন তিনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাটা কোম্পানির ম্যানেজার ও নির্বাহী পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ চাকরিতে থাকার পরও ওডারল্যান্ড আমাদের গেরিলাদের রণকৌশলে শিক্ষিত করে তুলেছিল। কোমরে রাইফেল ঝোলানো ওসমানীর সঙ্গে দেখা হবার ছবিটিতে চোখ বুলালেই বোঝা যাবে, কেমন যোদ্ধা তিনি ছিলেন। আমৃত্যু বাংলাদেশের মঙ্গল ও ইতিহাস বিকৃতির নিরসন কামনায় ব্রতী ওডারল্যান্ডকে আজকের প্রজন্ম কতটা জানে? কতটা বিস্তৃত তাঁর জীবনী ও যুদ্ধগাথা? মনে পড়ছে, চট্টগ্রাম বন্দরের অদূরে ঝাউগাছের ছায়ায় শায়িত দুই রুশ নাবিকের কথা। স্বাধীন দেশে নানা ধরনের বিপত্তি, সঙ্কট আর জঞ্জাল রেখে গিয়েছিল পাকি বাহিনী। এরা ও এদের দোসর রাজাকারদের পোঁতা মাইন সরানোর কাজে সুদূর রাশিয়া থেকে আগত এই দুই সৈনিক মাইনের আঘাতে প্রাণ হারান। জানি না তাদের কবরগুলো এখন কি অবস্থায়, কেমনভাবে রাখা আছে। আমাদের দেশ ও জাতির কাঁধে আজ যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয়তাবাদ বা জামায়াতের নামে পাকিদের প্রেতাত্মার আছর দেখি; ভয় হয়, প্রশ্ন জাগে, আমরা কি আসলেই সঠিকভাবে এগুচ্ছি? তবু আশার মৃত্যু নেই, সঙ্কট ও দুর্যোগে বরাবরের মতো ঝলসে ওঠা বাংলাদেশ এবার ভুল করেনি, একাত্তর ও পরবর্তী পর্যায়ে মতদ্বৈধতায়-পার্থক্যে দূরের নয়, এখন ঠিক পথে। সিডনি এসেছিলেন পর্যটন ও বেসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী বাম নেতা রাশেদ খান মেনন। এক সন্ধ্যায় অনুপম বাংলাদেশকে ও আমাদের পর্যটন বা ব্যবসা নিয়ে কথাবার্তার এক আয়োজনে তাঁর কণ্ঠে ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা’ শুনে পুলকিত বোধ করেছি। বোধোদয় বা ফিরে আসার এই কণ্ঠ শুনতে ভাল লাগে। পথভ্রষ্ট কাদের সিদ্দিকী ও মুক্তিযোদ্ধা ড. কামাল হোসেন এ দেশের সংবিধান প্রণেতা। এদের সুমতি কিংবা প্রায়শ্চিত বিজয় দিবসের প্রাক-ভাবনাকে জাগিয়ে রাখে। কম্বোডিয়া ভ্রমণকালে তাদের জাদুঘরে উৎকীর্ণ সে দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনগুলোর লিখিত রূপ দেখেছি। জাতি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বা বেইমানি করে কোন মানুষ ভাল থাকে না, থাকতে পারে না। যে কারণে বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামানের সন্তানরা গৌরবে বাঁচেন; মুশতাকের ছেলে পিতার পরিচয়ে বাঁচতে ভয় পায়! আমাদের দেশ, জনক, মুক্তিযোদ্ধা ও মাটির পরিচয়ে বাঁচার মহতী দিন বিজয় দিবস। এই দিবস পথভ্রষ্টদের প্রায়শ্চিত্তের দিনও বটে। জয় বাংলায় শুদ্ধতা নিয়ে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাওয়াই হোক এবারকার বিজয় দিবসের প্রার্থনা।
×