ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ বেতারের হীরকজয়ন্তী

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪

বাংলাদেশ বেতারের হীরকজয়ন্তী

যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেতারযন্ত্র আবিষ্কার আজও বিপুল বিস্ময়। আর এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন ইতালির বিজ্ঞানী মার্কোনি। অবশ্য তার অনেক আগে বেতার তরঙ্গ নিয়ে অনেকেই গবেষণা শুরু করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে জার্মানির ব্রাউন, রাশিয়ার পপভ, বিলেতের লজিও মুরহেড এবং আমেরিকার ফেসেন্ডেন ও চেসলার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তবে তাঁদের গবেষণা এক পর্যায়ে আমাদের বিক্রমপুরের সন্তান বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে বেতার সঙ্কেত প্রেরণা ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন। এরপর ১৮৯৯ সাল থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে বিলেত-আমেরিকার বেতার সংযোগ স্থাপিত হয়। ১৯১০ সালে বিজ্ঞানী করেস্ট প্যারিস থেকে এবং নিউইয়র্ক থেকে প্রথম বেতার সম্প্রচার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯১৭ সালেও প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বেতার সম্প্রচার প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়। এভাবেই শুরু হয় বেতার সম্প্রচার বা বেতার অনুষ্ঠানের নবযাত্রা। ভারতীয় উপমহাদেশে বেতার সম্প্রচার শুরু হয় ১৯২৪ সালে। এটি শুরু করে মাদ্রাজের একটি রেডিও ক্লাব। ১৯২৬ সালে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে এবং এই কোম্পানিটি কলকাতা ও বোম্বাইয়ে ১.৫ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটারের সাহায্যে দুটি কেন্দ্র স্থাপন করে। এরপর ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ সালে দিল্লীতে এবং ১৯৩৬ সালে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিও স্থাপন করে। এভাবেই উপমহাদেশে প্রথম পর্যায়ে বেতার কেন্দ্র স্থাপন শুরু হয়। পূর্ববাংলায় প্রথম বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয় ঢাকায়। ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্থাপিত এই কেন্দ্রটির প্রথম ধ্বনি ছিল ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র’। পরে কেন্দ্রটির নামকরণ করা হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও, ঢাকা। এটি স্থাপন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নাজিরউদ্দীনের ৬২ নম্বর বাড়িতে। বর্তমানে এটি শেখ বোরহান উদ্দীন কলেজ। এটি ঐদিন বিকেলে উদ্বোধন করেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। প্রথম দিনের প্রথম ঘোষক ছিলেন শ্রী ত্রিলোচন। স্টেশন কলের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেরিত ইংরেজীতে লেখা একটি বাণী পাঠ করে শোনানো হয়। এরপর ছোটদের আসর খেলাঘর, কাজী নজরুল ইসলামের লেখা সঙ্গীত আলেখ্য, সুধীর সরকারের নাটক দুয়ে দুয়ে ও আন্দালিব শাদানীর উর্দু নাটক চাঁদিকে টুকরে প্রচারিত হয়। কেন্দ্রটির ৬ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয় কল্যাণপুরে। প্রচার সীমানা ছিল ২৫ মাইল। কেন্দ্রটির প্রথম অধিকর্তা নিযুক্ত হন ড. অমূল্য বোস। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে উপস্থিত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও বুদ্ধদেব বসু। এ উপলক্ষে ‘নিখিল ভারত বেতার বাণী’ নামে একটি সুভ্যেনিয়র প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হলে অল ইন্ডিয়া রেডিও, ঢাকার নাম পাল্টে রাখা হয় পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস, ঢাকা। পরবর্তীকালে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা। পরে পর্যায়ক্রমে পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো স্থাপন করা হয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ কেন্দ্রগুলো পাকিস্তানী সৈন্যের দখলে ছিল। কিন্তু একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে বেতারকর্মী বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে প্রথম বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরে সকল কেন্দ্র বাংলাদেশ বেতারÑ এই নাম ধারণ করে। আমাদের দুর্ভাগ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে খুনীরা। পাকিস্তানের আদলে রেডিও বাংলাদেশ ঘোষণা দেয়। ১৯৯৬ সালে আবার কেন্দ্রগুলো বাংলাদেশ বেতার অর্থাৎ স্বনামে ফিরে যায়। বাংলাদেশ বেতারের এই হলো ৭৫ বছরের পূর্ব ইতিহাস। এককালে অল ইন্ডিয়া রেডিও, ঢাকা তথা রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা বা বাংলাদেশ বেতার ছিল একমাত্র গণমাধ্যম। সরকার নিয়ন্ত্রিত হলেও এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্যোগ দুর্বিপাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি বিনোদনের বিষয়টি মাথায় রেখে নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার অব্যাহত রেখেছে। সত্তরের গোর্কি ও নির্বাচন, বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বেতারের ভূমিকার কথা কারোরই অজানা নয়। সত্তরের নির্বাচনের সংবাদ ও উপকূলীয় উপদ্রুত এলাকার খবর পরিবেশনে বেতারই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আবার একাত্তরের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণ পরের দিন বেতারেই প্রচারিত হয়েছিল। আবার ২৬ মার্চ রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম কেন্দ্রে এম এ হান্নানের কণ্ঠে প্রথম বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ঐদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়। জনাব হান্নানই ঐ ঘোষণা দ্বিতীয়বার পাঠ করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন চট্টগ্রাম বেতারের স্ক্রিপ্ট রাইটার বেলাল মোহাম্মদ। ফটিকছড়ি কলেজের উপাধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ও ডাক্তার শফি। এই কেন্দ্রটি মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনটি পর্বে অনুষ্ঠান প্রচার করে। প্রথম পর্ব কালুরঘাট, দ্বিতীয় পর্ব আগরতলা ও তৃতীয় পর্বে মুজিবনগর। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় ও অনুষ্ঠান প্রচারে আরও যাঁরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তাঁরা হলেন : আবদুল্লাহ আল ফারুক, শরফুজ্জামান, সৈয়দ আবদুল শাকের, মোহাম্মদ ফারুক, নাসিমুল কাদের চৌধুরী, রাশেদুল হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, আমিনুর রহমান, মুস্তফা আনোয়ার, কাজী হাবিব উদ্দিন প্রমুখ। জীবন বাজি রেখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন স্বাধীনতাকামী শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অধ্যাপক ও রাজনীতিকবৃন্দ। অনুষ্ঠান পর্বের কার্যকর নিয়মিত অংশ নিতেন “সৈয়দ আলী আহসান, ফয়েজ আহমদ, তোয়াব খান, এম আর আখতার মুকুল, কামাল লোহানী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, উম্মে কুলসুম (মুশতারী শফি) প্রমুখ। বাংলাদেশ বেতার অনুষ্ঠান প্রচারের পাশাপাশি একটি বেতার মুখপত্র প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। এই প্রকাশনাটির নাম বেতার বাংলা। এটির পূর্বনাম এলান। পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। এলানের প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি শাহাদত হোসেন। ১৯৭২ সালে এটির নামকরণ করা হয় বেতার বাংলা। বেতার বাংলার বয়স ৬৪ বছর হলো। এটি প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র হলেও সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বেতার প্রকাশনা থেকে ইংরেজী বুলেটিন ও শাপলা শালুক নামে স্বল্পায়ুর আরও দুটি পত্রিকা বের হয়েছিল। আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবময় দিন ১৬ ডিসেম্বর। কাকতালীয় হলেও সত্য পঁচাত্তর বছর আগে ১৬ ডিসেম্বরের এক শীত-বিকেলে বাংলাদেশ বেতারের নবযাত্রা শুরু হয়েছিল। সেকালে একমাত্র গণমাধ্যমটির স্থাপনের কথা আমরা অনেকেই ভুলে যাই ১৬ ডিসেম্বর। এই প্রতিষ্ঠানের বয়স ৭৫ বছর, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখনও সমহিমায় প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় বেতার ছিল শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম। এখন আকাশ টিভির ছড়াছড়ি। টিভির ছড়াছড়ি কথাগুলো কিন্তু এখনও ইথারের মাধ্যমে সম্প্রচার করা হয় অর্থাৎ বেতার প্রযুক্তি থেকে এর উন্নততর আবিষ্কার। যার আধুনিক নাম এখন স্যাটেলাইট। বেতার এখন বিনোদন মাধ্যম নয়। বেতারের কর্মপদ্ধতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা। জীবন নির্বাহের অনুষঙ্গগুলো ধারণ করে বেতারকে এখন টিকে থাকতে হচ্ছে। তাই বলে বেতার কি অবলুপ্ত হবে? কখনও নয়। বেতার আপন বৈভবে শত কোটি বছর টিকে থাকবে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বেতারের ৭৫ বছর পূর্ণ হবে অর্থাৎ হীরকজয়ন্তী। বিজয় দিবসের পাশাপাশি এদিন বিজয়ের আনন্দ নিয়ে ব্যাপকভাবে হীরকজয়ন্তী পালন করা উচিত।
×