ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শত শত লোক নেমেছে নদীতে ;###; ৫ দিন পর মাস্টারের লাশ উদ্ধার

সুন্দরবনে আরও নতুন এলাকায় তেল সরানোর কাজ চলছে

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবনে আরও নতুন এলাকায় তেল সরানোর কাজ চলছে

বাবুল সরদার, বাগেরহাট থেকে ॥ সুন্দরবনে তেল অপসারণ কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয়েছে। রবিবার সকালে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগমারি থেকে আন্ধারমানিক পর্যন্ত আরও ১০ কিমি নতুন এলাকায় তেল অপসারণ শুরু হয়েছে। এ কাজে বনসংলগ্ন জয়মনি, চিলা, বাঁশতলা, বৈদ্যমারীসহ ৭-৮ গ্রামের মানুষ অংশ নিয়েছে। এছাড়া বন বিভাগের শতাধিক নৌকায় দুইশ’ শ্রমিক তেল অপসারণে কাজ করছেন। তেল অপসারণে এলাকাবাসীকে উৎসাহিত করতে প্রতি লিটার তেল আরও ১০ টাকা সংযোজন করে ৪০ টাকায় ক্রয় করা হচ্ছে। রবিবার দুপুর থেকে বাড়তি মূল্যে তেল ক্রয় করা হচ্ছে বলে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম বাবুল জানিয়েছেন। বন বিভাগ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভাসমান তেল অপসারণে এলাকাবাসীকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মু: শুকুর আলী জানান, রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চল্লিশ হাজার দুইশ’ লিটার তেল সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতি লিটারে আরও ১০ টাকা অধিক মূল্যে দেয়ার ফলে স্থানীয়রা উৎসাহিত হয়েছেন। সোমবার থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আব্দুস সামাদ এদিন সরেজমিনে তেল ক্রয় কেন্দ্রের এবং তেল অপসারণ কাজের অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মু: শুকুর আলী, পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন, ওয়াল্ড লাইফ কনজারভেশনের সিএফ তপন কুমার দে প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ১২ সিদ্ধান্ত ॥ রবিবার সচিবালয়ে নৌমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েলজনিত দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যর ওপর সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সিদ্ধান্তসমূহ হলোÑ স্থানীয় পদ্ধতিতে তেল অপসারণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং জোরদার করা, তেল সংগ্রহ ও ক্রয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, আরও কয়েকটি ক্রয় কেন্দ্র খোলা এবং ভ্রাম্যমাণ ক্রয় কেন্দ্র খোলাসহ সংগৃহীত তেলের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বিপিসিকে অনুরোধ করা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করে স্বাস্থ্য ঝুঁকিরোধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, স্থানীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ঝুঁকিরোধে সহজ বোধ্য আকারে প্রচারণা চালানোর ব্যবস্থা গ্রহণ, সুন্দরবনের অভ্যন্তরের জলাভূমির মৎস্য সম্পদ রক্ষায় তথ্য সংগ্রহ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, কাঁকড়া ও মৎস্য আহরণকারীসহ ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে ত্রাণের ব্যবস্থা গ্রহণ, দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, সুন্দরবনের ভেতরে দুর্ঘটনাকবলিত স্থানসহ অন্যান্য স্থানে নৌচলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করা, দুর্ঘটনাকবলিত এলাকায় যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে, সেজন্য উক্ত এলাকায় কোস্ট গার্ডের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, দুর্ঘটনাকবলিত এলাকার পার্শ্ববর্তী উপকূলীয় এলাকায় যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ সুপারগণকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সুন্দরবনের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে পানির মান পরীক্ষা অব্যাহত রাখা এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রতিবেশ সুরক্ষা। বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব আবুল কালাম আজাদ, নৌপরিবহন সচিব শফিক আলম মেহেদি, জ্বালানি সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান সভায় উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী জানান, ‘যে পদ্ধতিতে তেল সংগ্রহ হচ্ছে, সে পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে। বর্তমানে সংগৃহীত তেল ৩টি কেন্দ্রে ক্রয় করা হচ্ছে। আরও কয়েকটি ক্রয় কেন্দ্র বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দূরের যেসব স্থানে তেল সংগ্রহ করা হচ্ছে তা ভ্রাম্যমাণ ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে ক্রয় করা হবে।’ ৫ দিন পর ট্যাঙ্কারের মাস্টারের লাশ উদ্ধার ॥ সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ এর মাস্টার মোখলেসুর রহমানের (৫০) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ট্যাঙ্কার ডুবির পাঁচ দিন পর রবিবার সকালে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীর জয়মনির বাদামতলা এলাকায় তার মরদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয় গ্রামবাসী, জেলে ও বন বিভাগের কর্মীরা সেখানে গিয়ে মাস্টার মোখলেসুর রহমানের লাশ উদ্ধার করেন। তাঁর লাশ উত্তোলনের পর চাঁইপাইরেঞ্জ স্টেশন কার্যালয়ের সামনে আনা হয়। পরে বাগেরহাট সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্তের পর তাঁর লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে মংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন জানান। মোখলেসুর রহমান বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা গ্রামের উজ্জত আলীর ছেলে। আগেও তেলে ডুবে ছিল সুন্দরবন ॥ শুধু এবার নয়। ১৯৯৪ সালে এমভি পাবলিনা নামের একটি বিদেশী জাহাজ মংলা বন্দরের অদূরে পশুর নদীর বানিশান্তা এলাকায় ডুবে যায়। ওই জাহাজে থাকা ১৯৩ টন তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনে। ওই জাহাজ ডুবির সময় পশুর নদীতে ভাটা থাকায় তেলের একটি বিরাট অংশ ভেসে নেমে যায় বঙ্গোপসাগরে। সে কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির হয়নি। কার্গোটিকে করা হয় জ্বালানি ট্যাঙ্কারে ॥ জ্বালানি তেলের ট্যাঙ্কারসহ সব ধরনের কার্গো ও লাইটারেজ জাহাজের লাইসেন্স দেয়ার কর্তৃপক্ষ হচ্ছে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর। দেশের কুইক রেন্টারের জোয়ারের সময় হঠাৎ করেই কার্গোটি ট্যাংকার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামে জ্বালানি তেলবাহী জলযানে রূপান্তর করা হয়। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র না নিয়ে ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ ছাড়পত্র নেয় পেট্রোবাংলার কাছ থেকে। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞদের দাবি ॥ সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম এবং সুন্দরবন টুরিস্ট ক্লাবের প্রধান উপদেষ্টা এবং বাগেরহাট স্বাচিপের সভাপতি ডাঃ মোশাররফ হোসেন পৃথক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, পলি পড়ে ঘষিয়াখালী-মংলা আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেলটি ২০১১ সালের এপ্রিলে বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র তিন মাস নৌযান চলাচলের কথা বলা হলেও প্রায় চার বছর ধরে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বন বিভাগের আপত্তি উপেক্ষা করে চলছে সব ধরনের নৌযান। ইউনেসকো, পরিবেশবাদী সংগঠন এ ব্যাপারে আপত্তি করলেও সরকার তা আমলে নেয়নি। তিনি দাবি করেন, সরকারের উচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সেনা বাহিনী, নৌবাহিনী, প্রশাসনসহ সবাইকে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। সিপিবির মানববন্ধন ॥ সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে নদী খালে ছড়িয়ে পড়া ওই তেল দ্রুত অপসারণের করে বন ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষার দাবিতে সিপিবি মানববন্ধন করেছে। রবিবার দুপুরে সিপিবির শহর শাখা উদ্যোগে বাগেরহাট শহরের সাধনার মোড়ে এই মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা ওই মানববন্ধন কর্মসূচী চলে। সিপিবির ওই মানববন্ধনে ওয়ার্কার্স পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও মহিলা পরিষদ সংহতি প্রকাশ করে। মানববন্ধনে বক্তব্য দেন সিপিবির বাগেরহাট পৌর শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম যাদু, ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি দাস, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিল্পী সমাদ্দার, ছাত্র ইউনিয়নের জেলা শাখার আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম সজীব প্রমুখ।
×