ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

একজন শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য এত আয়োজন?

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪

একজন শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য এত আয়োজন?

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য নিরলস চেষ্টা চলছে অনেকদিন ধরে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনা অথবা শেখ রেহানার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তবে কথায় বলে ‘রাখে আল্লাহ্ মারে কে?’ ভাগ্যক্রমে তাঁরা দু’জনই দেশের বাইরে ছিলেন বলে সেই দফায় বেঁচে গেছেন। তবে ঘাতকদের চেষ্টা থেমে নেই। সর্বশেষ খবর হলো জেএমবি শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য তিনশ’ নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ভারতে। এমন খবর দিচ্ছে জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক তাদের ৯ ডিসেম্বর সংখ্যায়। বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে তারা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে রীতিমতো দোকান খুলে বসেছে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। অভিযোগ আছে তাদের এই কর্মকা-ে সহায়তা করছেন সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাঁর ওপর অনেক হামলা হয়েছে। কখনও তাঁর গাড়িবহরে কখনও বা তাঁকে বহনকারী ট্রেনে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে ৮ দলীয় জোটের জনসভায় যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পাদদেশে শেখ হাসিনার শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়লে ২৩ জন নিহত হন। এদের নয়জন নিহত হন শেখ হাসিনাকে মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করতে গিয়ে। পরে এসব লাশকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে চট্টগ্রামের অভয়মিত্র শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। সে সময় যার হুকুমে এই গুলি চালানো হয়েছিল সেই মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদাকে বেগম জিয়া ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এলে পদন্নোয়ন দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার দলীয় সমাবেশে তাঁকে হত্যার জন্য ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আবারও নেতাকর্মীদের মানববর্মের কারণে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। সেই হামলায় আহত হন প্রায় তিনশ’ জন। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে একটি জনপ্রিয় ইংরেজী জাতীয় দৈনিকের মাসিক সাময়িকীতে এই হামলার সঙ্গে বেগম জিয়ার পুত্র তারেক জিয়ার পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা বর্ণনা করে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘ঞযব চৎরহপব ড়ভ ইড়মৎধ’ শিরোনামে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই সাময়িকীটি বাজারে আসার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। এটি ছিল ফখরুদ্দিন সরকারের আমলের ঘটনা। সেই সাময়িকীতে তারেক রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশের দুটি ভয়াবহ জঙ্গী সংগঠন, আন্তর্জাতিক খতমে নবুয়ত ও জেএমবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্ণনা করা হয়। বর্তমানে সেই জেএমবি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে খতমে নবুয়ত সৌদি অর্থে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল এবং তাদের সার্বিকভাবে সহায়তা করেছিল তারেক রহমান ও তৎকালীন সরকার এমন খবর দিচ্ছে সেই মাসিক পত্রিকাটি। খতম পার্টির আগে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়েছিল। এই দুটি দলেরই মূল টার্গেট ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও আহমদিয়া জামায়াত। বিএনপি বা তারেক রহমান ছাড়াও এই দুই জঙ্গী সংগঠন বেগম জিয়ার চারদলীয় জোটের অন্যতম সঙ্গী জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিল। শেখ হাসিনা ও আহমদিয়া জামায়াত ছাড়াও তারা দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেও তাদের শত্রু জ্ঞান করত। সে সময় বেগম জিয়া সরকার কারও জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। বরং অনেক স্থানে তারা খতম পার্টি আর তাদের মিত্রদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সহায়তা দিতে তৎপর থেকেছে। ২০০৫ সালে খতমে নবুয়তের মুফতি নূর হোসেন নূরানি বগুড়ার এক জনসভায় ঘোষণা করেন ‘তারেক রহমান আমাদের আমিরের সমবয়সী এবং আমরা আমাদের কর্মসূচী নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করি এবং তার পরামর্শ নেই’। সাময়িকীতে লিখেছে তারেককে এসব ব্যাপারে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিতেন এনএসআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। জেএমবি, খতমে নবুয়ত ছাড়াও সে সময় গড়ে উঠে হুজি, জেএমজেবি, হিযবুত তাহরীর, হিযবুত তওহিদসহ আরও বেশকিছু জঙ্গী সংগঠন। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দায়ে গ্রেফতারকৃত মুফতি হান্নান তার দেয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন তাঁর সঙ্গে হাওয়া ভবন ও তারেক রহমানের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মুফতি হান্নান কোটালীপাড়ায় শক্তিশালী বোমা পুঁতেছিলেন শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে। তারেক রহমানের সঙ্গে মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে দুবাইতে সাক্ষাত হয়েছিল বলে দেশে ও দেশের বাইরের একাধিক সংবাদপত্রে ২০০৭ সালে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেই সাক্ষাতের সময় তার সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা শাখার একজন শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। এই সাক্ষাতের উদ্দেশ্যই ছিল দেশে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করা। অন্য আর একটি সূত্রের মতে তারেক রহমানের পক্ষে তাঁর বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুন এই সাক্ষাত করেন। আইনের দৃষ্টিতে তারেক রহমান বর্তমানে পলাতক হলেও গিয়াস আল মামুন কারাগারে। তবে তারেক রহমান চিকিৎসার নামে দীর্ঘদিন লন্ডনে অবস্থান করে সেখানে বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্র করার জন্য নানা ধরনের কাসিমবাজার কুঠি সৃষ্টি করেছেন। সেসব কাসিমবাজার কুঠিতে নিয়মিত দেশ থেকে গিয়ে তার দলের বিভিন্ন পদের নেতা-নেত্রীরা ধরনা দেন এবং তা দেশে এসে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। ২০০০ সালে ভারত ও বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের দেয়া তথ্য মতে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ফারুক-রশিদ গং শ্রীলঙ্কার এলটিটিআইয়ের ঘাতকদের ভাড়া করেছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। এ কাজের জন্য তারা এলটিটিআইয়ের দু’জন সক্রিয় মুসলমান সদস্য, নাওজিয়া খাতুন ও উম্মে সালিমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য। এদের একজনের আবার বিবাহসূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফারুক-রশিদ গংদের সঙ্গে কলকাতায় এই ঘাতকদের কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছিল। কিন্তু তাদের সেসব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় ভারত-বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের তৎপরতায়। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাঁকে হত্যা করার জন্য কমপক্ষে নয়বার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁকে হত্যার যতগুলো পরিকল্পনা হয়েছে তার সঙ্গে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সম্পর্ক ছিল। পাকিস্তান বাংলাদেশ সৃষ্টির বাস্তবতাকে কখনও মেনে নিতে পারেনি। গত বুধবার পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ এক বক্তব্যে স্বীকার করেছেন ভারতের সঙ্গে তিনি কারগিল যুদ্ধ শুরু করেছিলেন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারতের ভূমিকার প্রতিশোধ নিতে। এখন কোনকিছুই আর রাখঢাক করে করা হয় না। প্রশ্ন উঠতে পারে একজন শেখ হাসিনাকে হত্যা করে কার কী লাভ? লাভ আছে। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা সাহস করে যতটুকু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তা তাঁর দলের অন্য কেউই পারবেন বলে মনে হয় না। সব সময় যে তিনি সব সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নেন তাও কিন্তু নয়। তবে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত গত ছয় বছরে তিনি নিয়েছেন যা অন্য কেউ নেয়ার সাহস করতেন না। ২০১৩ সালে ৫ মে হেফাজত নামক একটি ভয়াবহ জঙ্গীগোষ্ঠী দেশের রাজধানীই দখল করে নিয়েছিল। তাদের সার্বিক মদদ দিয়েছিল সংসদে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, কিছু সুশীল সমাজ, বেশকিছু ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং কতিপয় স্বঘোষিত নাস্তিক। তাদের সকলের অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল সেই রাতই যেন শেখ হাসিনা সরকারের শেষ রাত হয়। হেফাজতের টার্গেট ছিল পরদিন তারা বঙ্গভবন দখল করবে আর মতিঝিলে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সকল ব্যাংকের ভল্ট লুট করবে। সেই রাতে কোন রক্তপাত ছাড়া যেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হেফাজতি জঙ্গীদের হাত থেকে রাজধানীকে রক্ষা করেছিল তা নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও সাহসের পরিচয় বহন করে। সেই রাতের ঘটনার পর দেশের বেশকিছু সুশীল ব্যক্তি, সংগঠন ও দেশী-বিদেশী কিছু মিডিয়া এমনভাবে প্রচার করার চেষ্টা করেছে যে, সেই রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হাজার হাজার ‘তৌহিদী’ জনতা প্রাণ হারিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে তারা তা প্রমাণ করতে পারেনি। এটি ছিল জনগণ ও বিশ্বকে স্রেফ বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা। শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলে একাত্তরের মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বন্ধ করা যাবে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। তাঁর অবর্তমানে বাংলাদেশকে আবার একটি পশ্চাদমুখী ও সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে বলে অনেকেরই ধারণা। বাংলাদেশে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী আছে যারা এখনও মনে করে একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি ভুল ছিল। একজন শেখ হাসিনাকে সরাতে পারলে ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশকে আবার একাত্তর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া সহজ হবে। শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর বাংলাদেশ এখন আর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের অভয়ারণ্য নয়। এটি অনেকের জন্য অস্বস্তির কারণ। সেই কারণেই তাঁকে সরিয়ে দিতে পারলে সব ল্যাটা চুকে যায়। শেখ হাসিনা ছিলেন বলে অসাংবিধানিক উপায়ে জাতীয় নির্বাচন দেয়ার জন্য দেশের এবং দেশের বাইরের নানামুখী চাপ অগ্রাহ্য করে তিনি ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছেন। পদ্মা সেতু অর্থায়নের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ব্ল্যাকমেলকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন। সুতরাং শেখ হাসিনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে অনেকে চেষ্টা করতেই পারে এবং এই চেষ্টা চলতেই থাকবে। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম ও ২০০৪ সালে ঢাকায় তাঁকে রক্ষা করার জন্য অনেক নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ তেমন নেতাকর্মী কী আওয়ামী লীগে নতুন করে তৈরি হচ্ছে? সার্বিক বিচারে তাতো মনে হচ্ছে না। উল্টো নিজ দলেরই কতিপয় অপরিণামদর্শী নেতাকর্মী তাদের ক্রিয়াকর্মের কারণে তাঁকে অনেক সময় শারীরিকভাবে না হলেও রাজনৈতিকভাবে বিপদে ঠেলে দিচ্ছেন। এখনই এগুলোকে ছাঁটাই করার উপযুক্ত সময় বলে তাঁর হিতাকাক্সিক্ষরা মনে করেন।
×