ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শুভ সূচনা হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক

পিডি বদলে বিশেষ সতর্কতা

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪

পিডি বদলে বিশেষ সতর্কতা

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বদলিতে কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। তাছাড়া তিন বছরের আগে বড় কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হলে পিডিদের বদলি করা যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্যই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে গঠন করা হয়েছে একটি কমিটিও। এ বিষয়টিকে একটি শুভ সূচনা হিসেবেই দেখছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, এটির সময়োপযোগী এবং শুভ সূচনা। তবে এর পর কেনাকাটায় টেন্ডারিং এবং পরিবেশ সংক্রান্ত জটিলতার দিকে নজর দিতে হবে। অন্যদিকে বছর বছর এডিপির আকার বাড়লেও স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত শতভাগ বাস্তবায়নের রেকর্ড হয়েছে মাত্র চার বার। সূত্র জানায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় সেগুলোর বাস্তবায়ন পর্যায় যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালকের বদলি। এছাড়া প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হঠাৎ করে বদল হয়ে গেলে নতুন যিনি দায়িত্ব পান তার কাজ বুঝতেই বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়। ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে সার্বিক উন্নয়ন বিলম্বিত হয়। এ প্রেক্ষিতে সরকার তিন বছরের আগে প্রকল্প পরিচালক ও প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে বদলি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে গঠিত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তফা কামালকে। এছাড়া সদস্য হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিববৃন্দ। এ বিষয়ে কমিটির সদস্য ও পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, তিন বছরের আগে প্রকল্পের পিডি বদল করা যাবে না। যদি করতেই হয় তাহলে কমিটিতে প্রস্তাব আসতে হবে। কমিটি বিচার বিশ্লেষণ করে যদি মনে করে বদল করা দরকার তাহলে সুপারিশ প্রদান করবে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন দ্রুত করতে এ উদ্যোগ যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছি। কমিটির কার্য পরিধির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রথমত, পদোন্নতি/উচ্চতর পদায়ন এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা/বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয় ছাড়া তিন বছর মেয়াদ সমাপ্তির পূর্বে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে নিয়োজিত প্রকল্প পরিচালক এবং প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বদলি সংক্রান্ত প্রস্তাব বিবেচনা করে সুপারিশ প্রদান করবে। দ্বিতীয়ত, প্রকল্প সমাপ্তির কারণে বদলির ক্ষেত্রে কমিটির নিকট প্রস্তাব উপস্থাপনের প্রয়োজন হবে না। তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে জারিকৃত নিয়োগ বা বদলি আদেশসমূহ কমিটির সুপারিশের আওতা বহির্ভূত থাকবে এবং তা সরাসরি কার্যকর হবে। চতুর্থত, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্প পরিচালক বা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বদলি এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব বড় বড় সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম। যেমন বড় সমস্যাগুলো হচ্ছে ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা, পরিবেশ ছাড়পত্র সংক্রান্ত, প্রকিউরমেন্ট টেন্ডারিং এবং প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা। প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায় পিডি চলে গেলে মানুষ হয়ত বদল করা যায়, কিন্তু যে দক্ষতা ও জ্ঞান চলে যায় তা বদল করা যায় না। কেননা একজন নতুন মানুষকে নিয়োগ দেয়া হলে তার শিখতে শিখতেই অনেকটা সময় চলে যাবে। তাই আমি মনে করি এটি একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে পাশাপাশি এ কথাও বলতে চাই এ উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। কেননা প্রকল্প পরিচালক বদলি করা হলো না, ভূমি অধিগ্রহণও সময় মতো হলো, কিন্তু টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দেয় তাহলে এর কোন সুফল আসবে না। প্রকল্প আটকে থাকবেই। এজন্য বড় কয়েকটি সমস্যার বিষয়ে এভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর পর প্রকিউরমেন্ট টেন্ডারিং এবং পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় দুটিতে নজর দিতে হবে। অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়ন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেছেন, যেভাবেই হোক প্রকল্পের কাজ দ্রুত করে সর্বোচ্চ এডিপি বাস্তবায়ন করতে হবে। এডিপির অগ্রগতি নিয়ে প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে এ তাগিদ দেন তিনি। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে বৃহস্পতিবার রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় ও বিভাগুলোর কোনটির কি অবস্থা, প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না কেন, সেগুলোর সমস্যা কি, কি কারণে এরকম হচ্ছে এবং এর সমাধান কি হবে এসব বিষয়ে আলোচনার পর দিক নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে। বৈঠকের বিষয়ে পরিকল্পনা সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বলেছি এ অর্থবছরে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যদি আপনারা সহায়তা করেন। আর যারা একেবারেই বাস্তবায়নে অপারগতা প্রকাশ করবেন, তারা এখনই অর্থ সমর্পণ করতে পারেন। যাতে আমরা সে টাকা অন্য প্রকল্পে বরাদ্দ দিতে পারি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অনেক সচিব জানিয়েছেন ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। কিন্তু পেমেন্ট বাকি আছে। দু-তিন মাসের মধ্যেই দেখবেন বাস্তবায়ন অনেক বেড়ে গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ঘন ঘন পিডি বদল সত্যিই আকেটি বড় সমস্যা। সেক্ষেত্রে সরকারের এ সিদ্ধান্ত খুবই বাস্তবসঙ্গত। তবে অনেক সময় বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দেখা যায় পিডিরাও প্রকল্পের বাস্তবায়নে বাধা হয়ে যায়। যেমন অদক্ষতাসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সেক্ষেত্রে যেহেতু সেই ধরনের পিডিদের বদলির সুযোগ রয়েছে তাই সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এর ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়বে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে বিশাল আকারের মোট ৮৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৫২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা ব্যয় করার কথা রয়েছে। প্রকল্প সহায়তা হিসেবে বিদেশী উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ২৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর বাইরে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর তহবিল থেকে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এযাবতকালে গৃহীত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র চারবার শতভাগ এডিপি বাস্তবায়নের মাইলফলক ছুঁয়েছে। তা হচ্ছে ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে এডিপি ছিল মোট ১ হাজার ২০৩ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন হার ছিল ১০৪ শতাংশ। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন হার হয়েছিল শতভাগ। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরের এডিপি ছিল ৪ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন হার ১০১ শতাংশ এবং ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ৫ হাজার ১০৩ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন হার ১১২ শতাংশ।
×