ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তহবিল প্রাপ্তির লক্ষ্য অর্জনই এবারের বড় সাফল্য

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

তহবিল প্রাপ্তির লক্ষ্য অর্জনই এবারের বড় সাফল্য

কাওসার রহমান, লিমা (পেরু) থেকে ॥ শেষ পর্যন্ত লিমা জলবায়ু সস্মেলনে সবুজ জলবায়ু তহবিলের অর্থের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার বা এক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সম্মেলনের একেবারে শেষে এসে আয়োজক দেশ পেরু এবং লাতিন আমেরিকার অপর দেশ কলম্বিয়া এ তহবিলে অর্থ প্রদানে এগিয়ে এলে সম্মেলন শেষ হওয়ার ঠিক একদিন আগেই এ তহবিলে প্রাথমিক পুঁজির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে এ তহবিলে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। যা থেকে জলবায়ুর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসাবে বাংলাদেশ সরাসরি লাভবান হবে। তবে এজন্য অর্থ প্রাপ্তির জন্য জুতসই প্রকল্প প্রণয়ন এবং তা ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার জলবায়ু তহবিলের অর্থ ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের নেতৃত্ব ন্যাশনাল ইমপ্লিমেন্টেশন এনটিটি গঠন করতে যাচ্ছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা সবুজ জলবায়ু তহবিলের পুঁজিয়ায়নকে এবারের জলবায়ু সম্মেলনের বড় অর্জন হিসাবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য এই তহবিল গঠন করা হলেও গত তিন বছর ধরে এটি শূন্য পড়ে ছিল। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ উদ্যোগের ফলে উন্নত দেশগুলো এতে অর্থ প্রদানে এগিয়ে আসে। যার ফলে গত চার মাসের ব্যবধানে সবুজ জলবায়ু তহবিলে এক হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অর্থের প্রতিশ্রুতি এসেছে। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের উপনেতা পরিবেশ সচিব নজিবুর রহমান সবুজ জলবাযু তহবিলে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এটি উন্নত দেশগুলোর অর্থ প্রদানের প্রাথমিক পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে এতে অর্থের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে মনে করছি। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী বছর ২০১০ সালে মেক্সিকো জলবায়ু সম্মেলনে গঠন করা হয় এই গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড বা সবুজ জলবায়ু তহবিল। এরপর শুরু হয় এর কাঠামো তৈরির কাজ। দোহা জলবায়ু সম্মেলনে এসে এই তহবিলের পরিচালনা বোর্ড গঠন করা হয় এবং এর কার্যলয় দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় এই তহবিল কাজ শুরু করলেও, কোন উন্নত দেশ তাদের প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী অর্থ প্রদান না করায় এই তহবিল এতদিন শূন্য পড়ে ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া কিছু পরিমাণ অর্থ দিয়ে নতুন এই সংস্থার অফিস খরচ চালিয়ে আসছিল। গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে জলবায়ু সামিট অনুষ্ঠানের পর নবেম্বরে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডে অর্থায়নে এগিয়ে আসে উন্নত দেশগুলো। ওই সম্মেলনেই এক লাফে এই তহবিলে ৯০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। এরমধ্যে যুকরাষ্ট্র একাই তিন শ‘ কোটি ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। এবারের লিমা জলবায়ু সম্মেলনে সবুজ জলবায়ু তহবিলের প্রাথমিক পুঁজির পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলার পূরণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। সম্মেলন চলাকালে কয়েকটি দেশ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলে এই তহবিলের পরিমাণ ৯৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে প্রধান উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া কোন অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি না দেয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন সম্মেলনের হাইলেভেল সেগমেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় এখনও সবুজ জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নে এগিয়ে না আসায় এই দেশটির সমালোচনা করেন। তাঁর সমালোচনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া চার বছরে এই তহবিলে ১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই সঙ্গে আয়োজক দেশ পেরু এবং প্রতিবেশী দেশ কলম্বিয়া প্রত্যেকে ৬০ লাখ ডলার করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে শেষ পর্যন্ত লিমা জলবায়ু সম্মেলনে সবুজ জলবায়ু তহবিলে প্রাথমিক পুঁজির পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রত্যাশা ছিল ১৫শ’ কোটি ডলারের। প্যারিস চুক্তির আইনী কাঠামো তৈরির কঠিন কাজ চলছে ॥ হঠাৎ করেই বদলে গেল সব পরিবেশ। সকাল থেকেই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছিল সবকিছু। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির কাঠামোতে সব দেশ মিলে এত প্রস্তাব দিয়েছে যে, পাহাড়সম সেই প্রস্তাবগুলো একত্রিত করে সবার খুশিমতো একটি কাঠামো তৈরি করা একদিনের মধ্যে সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছিল বৈকি। ঝড়ের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে এসে সেই পরিবেশ বদলে দিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। প্রেসিডেন্ট ওবামার পর কোন জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তির পদচারণায় হঠাৎ করেই বদলে যায় লিমা জলবায়ু সম্মেলনের পরিবেশ। শুধুু পদচারণায়ই নয়, বৃহস্পতিবার সকালে এসে একটি সাইড ইভেন্টে যোগ দিয়ে দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে উন্নত দেশগুলোর দফারফা করলেন তিনি। বললেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করা বন্ধ করুন। সেইসঙ্গে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বেশি কার্বন নির্গামনকারী কয়লা ব্যবহার করে সস্তায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ পরিহার করুন। তিনি সম্মেলনে যোগদানকারী সব দেশের উদ্দেশে বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে লিমার আলোচনা একটি সম্মিলিত প্রয়াস। এই সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা গ্রহণে কোন অজুহাত দেবেন না। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রয়াসকে অবহেলা করলে তা হবে ঐতিহাসিক নৈতিক ব্যর্থতা’। জন কেরি আরও বলেন, ‘লিমায় আমরা যদি নেতৃত্ব না দেই তাহলে ভবিষ্যত প্রজম্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। তাই নতুন পথের দিকে যেতে আমাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।’ সংবাদ সস্মেলনে জন কেরি তার দেশের রাজনৈতিক নেতাদেরও কঠোর সমালোচনা করেন, যারা জলবায়ু পরিবর্তনে বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে বিশ্বাস করছে না। তিনি বলেন, বিজ্ঞানীদের ৯৭ ভাগ গবেষণাই বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি সত্যি এবং বাস্তব ঘটনা। এটি ঘটে চলেছে। আর এই জলবায়ু পরিবর্তন মানবসৃষ্ট। এটা ঘটছে জৈব জ্বালানি পুড়িয়ে অতিমাত্রায় গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনের কারণে। বিশ্বে যে পরিবর্তন ঘটছে এটা অনুধাবন করতে ডক্টরেট ডিগ্রীর প্রয়োজন হয় না। তিনি বলেন, কোন একক দেশের পক্ষে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রত্যেক জাতিকে এজন্য দায়িত্ব নিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে বারাক ওবামা ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যোগ দেন এবং একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার প্রচেষ্ঠা কোপেনহেগেন এ্যাকর্ডে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রী থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার স্থান পায়। বারাক ওবামার পর যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি পেরু জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। কার্বন নিঃসরণ কমাতে চীনের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষরের পর পেরু জলবায়ু সম্মেলনে তার সরাসরি উপস্থিতি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। শেষ পর্যন্ত লিমা থেকে একটি ফল বেরিয়ে আসবে এমনটাই আশা করা হচ্ছে। কঠিন কাজ ॥ শেষ মুহূর্তে এসে লিমা জলবায়ু সম্মেলনে একটি এজেন্ডাই প্রধান হয়ে উঠেছে। সেটি হচ্ছে ২০১৫ সালে প্যারিসে সব দেশকে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় একটি চুক্তি স্বাক্ষরের আইনী কাঠামো চূড়ান্ত করা। গত সোমবার সকালে এ কাঠামোর একটি খসড়া বের হয়। তার ওপর গত দুইদিন সদস্য দেশগুলো তাদের মতামত দিয়েছে। সেই মতামতগুলোকে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে আরও একটি খসড়া প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ওই খসড়ার এক একটি প্যারায় এত প্রস্তাব এসেছে যে, সেগুলোকে সমন্বয় করে একটি চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করা কমিটির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ প্রত্যেক ক্লজেই সদস্য দেশগুলো তাদের প্রস্তাব দিয়েছেন। দুটি ওয়ার্কিং গ্রুপ সম্মেলন শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে মাত্র একটি প্যারা সর্বসম্মতভাবে ঠিক করতে পেরেছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্যারা ৩৪ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ২০২০ সাল নাগাদ সকল দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তাদের সম্পৃক্ততা জোরালো করবে। ফলে নির্ধারিত সময় শুক্রবার বিকালের মধ্যে এ খসড়া কাঠামো চূড়ান্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় নিগোসিয়েটররা পেরু সরকারের হস্তক্ষেপ চাইছে। একাধিক গ্রুপে এ প্রস্তাবগুলো নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে কাজ কঠিন হলেও লিমা সম্মেলন থেকে একটি ফল বেরিয়ে আসবে সেই সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠেছে। কারণ এখন পর্যন্ত লিমার আলোচনায় ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ে মধ্যে না হলেও শুক্রবার মধ্যরাতে কিংবা শনিবার ভোর নাগাদ লেগে যেতে পারে লিমার জলবায়ু সম্মেলনের ফল পেতে। সংসদীয় কমিটির তৎপরতা ॥ পরিবেশ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বৃহস্পতিবার নেপালের পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি, মাউন্টেন ফোরাম এবং ডেনমার্কের পরিবেশবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটির প্রধান ড. হাছান মাহমুদ এ বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। আর নেপালী কংগ্রেসের ছয় সদস্য এ বৈঠকে যোগ দেন। নেপাল ও বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়। এতে হিমালয়ের পানিসম্পদকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশই যাতে সুফল পেতে পারে সে ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করা হয়। বৈঠকে বলা হয়, নেপালে এক লাখ ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। নেপালে ওই বিদ্যুত তৈরি করে তা বাংলাদেশে কিভাবে নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। মাউন্টেন ফোরামের বৈঠকে উজান থেকে আসা পানির প্রভাব নিয়ে কাজ করতে সার্ক এনভায়রনমেন্টাল নেটওয়ার্ক গঠনের প্রস্তাব করা হয়। আর ডেনমার্ক সংসদীয় কমিটি বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে।
×