ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যতদিন মৌলবাদ থাকবে ততদিন শেখ হাসিনাকে সমর্থন করব

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

যতদিন মৌলবাদ থাকবে ততদিন শেখ হাসিনাকে সমর্থন করব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অমর একুশের গানের মাধ্যমে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মনস্তাত্ত্বিক জমিন তৈরি করেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এটি শুধু গান নয়, প্রকৃত অর্থে বাঙালী হওয়ার বাসনা। অন্যদিকে পঁচাত্তরের পর দেশের দুঃসময়ে প্রতিবাদলিপি নিয়ে হিথ্রো বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে জানিয়েছেন প্রতিবাদ। আপন কলমের শক্তিতে দেশ পুনর্গঠনের সময় সাহস করে সত্যি কথা বলেছেন। তাই তো গাফ্্ফার চৌধুরী ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ সমার্থক শব্দ। বায়ান্নর অমর একুশের গানের স্রষ্টা প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ৮০তম জন্মবার্ষিকীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। শুক্রবার বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ৮০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি। ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা ও হৃদয়ের উৎসারিত গহীন ভালবাসায় উদযাপন করা হয় বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের জন্মদিন। আর এমন সংবর্ধনাপ্রাপ্তিতে অভিভূত হয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন গাফ্্ফার চৌধুরী। নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রসঙ্গে বলেন, এদেশে সেক্যুলারিজ বা ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্যটি আজ হারিয়ে গেছে। চারদিকে পরিলক্ষিত হচ্ছে মৌলবাদের প্রবল প্রভাব। সরকার ওপর থেকে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও এটা বেড়ে উঠছে তৃণ থেকে। সামান্য কথাতেই কাউকে মুরতাদ ঘোষণা করা হচ্ছে। এমনকি একটি জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক নিরপেক্ষতার নামে মৌলবাদকে সহায়তা করছে। পুলিশ-র‌্যাব দিয়ে কিছু হবে না, আদর্শিক অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করতে হবে মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদকে। তাই সবার আগে মৌলবাদ ঠেকাতে হবে। তারপর গণতন্ত্রের ত্রুটিগুলো দূর করতে হবে। আর এই মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপোসহীনভাবে লড়াই করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছেন। এ পর্যন্ত নয়বার জীবনের ওপর হামলা হলেও দেশের হাল ধরে রেখেছেন। তাই যতদিন মৌলবাদ ধ্বংস না হবে ততদিন আমি শেখ হাসিনাকে সমর্থন করব। এখন তো অবস্থাটা এমন হয়েছে বিচারপতি, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেকেই নিজের বিবেককে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক আইনজীবীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের বিরোধিতা করছেন, তাহলে বলুন তাঁর বিকল্প কে? আপনি কী আবার দেশে মৌলবাদের উত্থান চান? আপনি কী চান দেশে আবার গ্রেনেড হামলা হোক অথবা মৌলবাদীরা ক্ষমতার ভাগিদার হোক? তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আজ মৌলবাদ নামক বিষফোঁড়ার আক্রমণে জর্জরিত। পুলিশ ও র‌্যাব দিয়ে এটা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার শিক্ষা, সচেতনতা ও আদর্শিক চেতনার প্রতিরোধ। অমর একুশের গান প্রসঙ্গে গাফ্্ফার চৌধুরী বলেন, আজ ৮০ বছর বয়সে যে সম্মান পেলাম তা আসলে একুশের গানের জন্য। এটা ভাষাশহীদ সালাম-বরকত-রফিকদের প্রাপ্য। আসলে ওই সময়টিতে আমি ছিলাম কলের পুতুল। মাথার খুলি উড়ে যাওয়া এক ভাষাশহীদের লাশ দেখে কবিতাটি লিখেছিলাম। প্রথমে আবদুল লতিফ ও পরে আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটি জনপ্রিয় হয়। আর এ গানে সুর দেয়ার জন্য পাকবাহিনীর হাতে জীবন দিতে হয়েছিল আলতাফ মাহমুদকে। আমি কখনও ভাবিনি এই গানটি একদিন সারাবিশ্বে গীত হবে। গানটি লেখার পর আমার চাচা বলেছিলেন, তুই মরা মানুষ নিয়ে এসব কি আজেবাজে কবিতা লিখেছিস? আবার দেশ স্বাধীনের পর তিনিই গর্ব করে সবাইকে বলতেন, এই গানটি লিখেছে আমার ভাইপো। স্বাধীতার পর একবার বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তুমি ওইরকম আরেকটা গান লেখ। জবাবে আমি বললাম, আপনিও তাহলে সাতই মার্চের মতো আরেকটি ভাষণ দিন। এরপর বাংলার ভাষার ওপর অন্য ভাষার আগ্রাসনের কথা উল্লেখ করে এই সাহিত্যিক ও সাংবাদিক বলেন, মাতৃভাষা বাংলার জন্য রক্ত দিলেও দুঃখের বিষয় আমরা এখন হিন্দির খপ্পরে পড়েছি। ভাষার ক্ষেত্রে আমরা সামনে না এগিয়ে উল্টো পিছিয়ে গেছি। অনেকটা যেন রাজনীতির মতোই হয়েছে ভাষার দশা। পেছনের স্মৃতি টেনে তিনি বলেন, পঞ্চাশ দশকের আমার প্রায় সকল সহযোদ্ধা ও বন্ধু যাঁরা তৎকালীন পূর্ব বাংলার রেনেসাঁস সংঘটনে ভূমিকা রেখেছেন তাঁরা সবাই আজ প্রয়াত। আমি তাঁদের স্মৃতিবাহক হয়ে বেঁচে আছি, যুদ্ধ করছি মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও বিবেকহীনতার বিরুদ্ধে। এই ঢাকায় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতো প-িত বাংলা ভাষার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারেননি। রবিরশ্মির শিল্পীদের পরিবেশনায় সম্মেলক কণ্ঠে জাতীয় সংগীত এবং একুশের গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এরপর মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং সম্প্রতি প্রয়াত দেশের বিশিষ্টজনদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। স্বাগত ভাষণ বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। সভাপতিত্ব করেন এমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের মহাপরিচালক মোনায়েম সরকার। জাতীয় সংবর্ধনা কমিটির পক্ষে মানপত্র পাঠ করেন কবি আসাদ চৌধুরী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আইটিআই সভাপতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। অনুষ্ঠান চলাকালে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মুঠোফোনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। এক্সিম ব্যাংকের পক্ষে নূরুল ফজল বুলবুল একুশের গানের রচয়িতার কাছে সম্মাননাসূচক একুশ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করেন। জন্মদিনের এ আয়োজনে দেশের বিশিষ্ট লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক-সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান গাফ্্ফার চৌধুরীকে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর প্রথম ফুল দিয়ে ভালবাসা নিবেদন করেন। এরপর শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে এইচ টি ইমাম, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দিপু মনি, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হক, বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, গণজাগরণ মঞ্চ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ঢাকা কলেজ, আওয়ামী সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখা, স্বভূমি লেখক সংঘ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষে ভাস্কর ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী, পেশাজীবী ঐক্য পরিষদ, মেহেন্দীগঞ্জ সমিতি, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের পরিবার, দৈনিক সমকাল, বাংলা একাডেমি কর্মচারী ইউনিয়ন, অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম, হামদর্দ ফাউন্ডেশন, যুক্তরাজ্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষে শফিকুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মুকিত চৌধুরী, বিটিভির মহাপরিচালক আসাদ মান্নান। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কবি সৈয়দ শামসুল হক, এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান, ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক, সাবেক সচিব এম মোকাম্মেল হক, ভাষা সংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন অর রশিদ, ড. আনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক আবেদ খান, বিবি রায় চৌধুরী, ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির মনোনয়নপ্রার্থী মিনা রহমান। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা নূহ উল আলম লেনিন, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার প্রমুখ। সৈয়দ শামসুল হক বলেন, একটি সুষ্ঠু সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে আজীবন সংগ্রাম করেছেন আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী। আর শুধু একুশের গানের জন্য নয়, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও যুক্তিবাদী নানা রচনার মাধ্যমেই তিনি বিশিষ্ট হয়ে আছেন। যতদিন বাঁচবেন শক্তিশালী কলমের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকবেন। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত শৈশবের স্মৃতিতাড়িত ‘লালগঞ্জের তীরে সূর্যোদয়’ কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। অন্য বক্তারা বলেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ এক সমার্থক শব্দ। আদর্শের প্রশ্নে তাঁর আপোসহীন অবস্থান সমকালে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি এক অসমসাহসী যোদ্ধা। বিশ্বব্যাপী যাঁরাই বাংলা ভাষাকে ভালবাসেন, লালন করেন তাঁদের অন্তরে তিনি এক আলোকবর্তিকা হিসেবে পথনির্দেশ করে যাবেন। তাঁর মতো গুণী বাঙালীর জীবন ও কর্মকে উত্তরপ্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে তাঁকে নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যচিত্র নির্মাণ করা জরুরী। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কাছে জাতির ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করার সুযোগ আজ এই সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে তৈরি হলো। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত গান পরিবেশন করেন হিমাংশু গোস্বামী। এছাড়া পঞ্চকবির গান ছাড়াও ছিল ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনগীতি। স্বাগত বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, বাঙালী জাতির জীবনে এমন অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা খুব কমই এসেছে। এই সংবর্ধনা তো তাঁরই প্রাপ্য যিনি একুশের ঐতিহাসিক গান রচনার পাশাপাশি একটি ধর্মনিরপেক্ষ-যুক্তিবাদী-মানবিক বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্মাণে কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে ৮০তম জন্মদিনে ৮০টি গোলাপে তৈরি মালা এবং একাডেমি প্রকাশিত পুস্তক উপহার দিয়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে শুভেচ্ছা জানানো হয়।
×