ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামসমৃদ্ধ এসব মাছ-মুরগি প্রতিনিয়ত খাচ্ছে মানুষ, বাড়ছে ঘাতক ব্যাধির আশঙ্কা ;###; বার বার অভিযানেও বন্ধ হচ্ছে না এসব পোল্ট্রিফিড তৈরি;###;ট্যানারি বর্জ্যে তৈরি পোল্ট্রিফিডে ক্যান্সারের উপাদান;###;ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামসমৃদ্ধ এসব মাছ-মুরগি প্রতিনিয়

মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য মিশিয়ে মাছ ও মুরগির খাবার তৈরির প্রক্রিয়া। হাজারীবাগ এলাকার অনুমোদনহীন কারখানা থেকে প্রতিদিন বর্জ্য দিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামসমৃদ্ধ মাছ ও মুরগির খাবার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ক্রোমিয়ামসমৃদ্ধ খাবারে রয়েছে মানবদেহে ক্যান্সার তৈরির উপাদান। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে তৈরি পোল্ট্রি খাবারে ক্রোমিয়ামের মাত্রা রয়েছে প্রায় ৫ হাজার পিপিএম। অথচ মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রা মাত্র ৩০ পিপিএম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ সংলগ্ন একাধিক কারখানা থেকে প্রতিনিয়ত মাছ-মুরগির বিষাক্ত খাবার উৎপাদন করা হচ্ছে। এসব কারখানা গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে। তাদের নেই কোন পরিবেশ ছাড়পত্র। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এসব কারখানায় একাধিকবার অভিযান চালানো হলেও বন্ধ করা যায়নি এর উৎপাদন প্রক্রিয়া। সম্প্রতি র‌্যাবের পক্ষ থেকেও একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। হাজার হাজার বস্তা পোল্ট্রিফিড জব্দ করা হয়েছে। জড়িত অনেক প্রতিষ্ঠান সিলগালাও করে দেয়া হয়েছে। তারপরও থামছে না এসব বিষাক্ত খাবার উৎপাদন। শুক্রবার র‌্যাব-২’র একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার সোনাতনগড়ে হাইপো ফিড কারখানায় অভিযান পরিচালনা করে। ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য মিশিয়ে মুরগি ও মাছের খাবার তৈরির অপরাধে দুই জনকে তাৎক্ষণিকভাবে কারাদ- দেয়া হয়েছে। এর আগেও র‌্যাবের পক্ষ থেকে কয়েকবার অভিযান চালানো হয়। কিন্তু অভিযান বন্ধ হয়ে গেলে পুনরায় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে শুরু হয় বিষাক্ত পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন প্রক্রিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে পোল্ট্রি খাবার তৈরির কারণে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। এলাকার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠেছে বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে তৈরি মুরগি ও মাছের খাবার তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় চামড়ার বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে মাছ-মুরগির খাবার। এসব খাবারে রয়েছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম, যা মুরগির মাংস, ডিম এবং মাছের মাধ্যমে মানুষের দেহে ঢুকে পড়ছে, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ক্যান্সার সৃষ্টির মতো ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে এতে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে মাছ ও মুরগির খাদ্য তৈরির সঙ্গে জড়িত ও আশপাশের লোকও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে। র‌্যাবের অভিযানে দেখা গেছে, ট্যানারি থেকে চামড়ার বর্জ্য এনে সিদ্ধ করে ছাদে শুকিয়ে শুঁটকি বানানো হচ্ছে। চামড়া থেকে তৈরি এ শুঁটকি ১৭ টাকা কেজি হিসেবে পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে। এ শুঁটকি কারখানায় গুঁড়ো করে তৈরি করা হচ্ছে মাছ ও মুরগির ক্ষতিকর খাবার। এসব কারখানায় তৈরি ফিড সরাসরি চলে যাচ্ছে বিভিন্ন মুরগির খামারে। হাইপো ফিড কারখানার পরিচালক সাইফুল ইসলাম ভ্রাম্যমাণ আদালতকে জানান, ৪ বছর ধরে এখানে এভাবে ফিড তৈরি হচ্ছে। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা জানান, উন্নতমানের ফিড এক শ’ কেজির মূল্য সাড়ে চার হাজার টাকা হলেও ট্যানারি বর্জ মিশ্রিত ফিড মাত্র তিন হাজার টাকায় পাওয়া যায়। ফলে অনেক খামারি এখান থেকে ফিড সংগ্রহ করে মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহার করছে। আনোয়ার পাশা জানান, কিছুদিন থেকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে উক্ত ফিড কারখানার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে এক বস্তা পোল্ট্রি ফিড ও এক বস্তা ফিশ ফিড কারখানা থেকে কিনে নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি ইউনিটের পরিচালক ডঃ মনিরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে মুরগির খাবারে ক্রোমিয়ামের মাত্রা রয়েছে ৪২০৫.৭০ পিপিএম, যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এবং উদ্বেগজনক। এছাড়া মাছের খাবার হিসেবে তৈরি খাবারে ক্রোমিয়ামের মাত্রা পাওয়া গেছে ৪ হাজার ৯৭১ পিপিএম। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছ ও মুরগির খাবারে মাত্র ৩০ পিপিএম মাত্রার বেশি ক্রোমিয়াম থাকাই ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হয়। ট্যানারির বর্জ্যে তৈরি মুরগি ও মাছের খাবার নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন। তাঁর গবেষণায়ও দেখা গেছে, এ ধরনের খাবারে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম রয়েছে। ওই বর্জ্য থেকে প্রস্তুত খাবার থেকে ক্রোমিয়াম মুরগি ও মাছের দেহের বিভিন্ন অংশে যেমন চামড়া, মাংস, যকৃৎ, হৃৎপি-, মস্তিষ্ক ও হাড়ে জমা হয়। লাগাতার দুই মাস ওই বিষাক্ত খাবার খাওয়ানোর পর মাছ ও মুরগিতে ০.৩২ মিলিগ্রাম হতে ৪ দশমিক ৫৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ক্রোমিয়াম জমা হয়, যা মানবদেহের সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক শ’ গুণ বেশি। মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম এভাবে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে লিভার ও কিডনিতে জমা হতে থাকে। এক পর্যায়ে ফুসফুস ও যকৃতের কার্যক্রম ব্যাহত করে জটিল রোগের সৃষ্টি করে। এছাড়া ক্রোমিয়াম ক্যান্সার রোগের অন্যতম কারণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত দুটি কারণে এই ক্ষতিকর ট্যানারি বর্জ্য মাছ ও মুরগির খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে চামড়ার বর্জ্য দিয়ে তৈরি এসব খাবার খাওয়ালে মুরগি বা মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। ডিমের আকারও বড় হয়। এছাড়া সস্তা দামে মুরগির খাবার পাওয়া যায় বলে খামারিরা এটি বেশি ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মুরগি বা মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রচুর প্রোটিন বা আমিষের প্রয়োজন। পশুর চামড়া প্রোটিন বা আমিষের বড় উৎস। চামড়ায় প্রচুর প্রোটিন থাকে। শুঁটকি মাছের গুঁড়ো এবং আমদানিকৃত মিটবন্ড ব্যবহার করে সাধারণত ফিড তৈরির কথা থাকলেও এগুলোর দাম বেশি হওয়ায় বিকল্প হিসেবে চামড়ার বর্জ্য ব্যবহার করছে খামারিরা। হাজারীবাগ ট্যানারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সময় ক্রোমিয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মেশানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে সালফিউরিক এসিড, সোডিয়াম, লাইম, এলডি, সোডা, ফরমিকা, ক্লোরাইড, সালফেট, এলুমিনিয়াম সালফেট প্রভৃতি। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় এসব কেমিক্যাল মেশানোর অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত প্রচুর পরিমাণে চামড়ার ঝুট বা বুশ বের হয়, যা ট্যানারি মালিকরা এগুলো বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেন। কিন্তু এক প্রকার অসাধু ব্যবসায়ী এই ঝুট বা বুশ সংগ্রহ করে মেশিন দিয়ে টুকরো করে পানি মিশিয়ে নরম করে। এরপর রোদে শুকানো হয়। শুকানোর পর মেশিনে গুঁড়ো করা হয়। এই গুঁড়োর সঙ্গে চাল বা ভুট্টোর গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি করা হয় মুরগি ও মাছের খাবার। বিশেষজ্ঞদের মতে, মারাত্মক ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম পোল্ট্রি ফিডের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এ ফিড মাছ বা মুরগি খেলে মলমূত্রের মাধ্যমে খানিকটা বের হয়ে গেলেও একটা বড় অংশ মাছ বা মুরগির শরীরে জমা থাকে। এমনকি ডিমেও জমা হয়। উক্ত মাছ, মুরগি বা ডিম খেলে মানুষের শরীরে ক্রোমিয়াম প্রবেশ করে এবং মলমূত্রের মাধ্যমে সবটা বের হতে না পেরে শরীরে জমা হতে থাকে এবং নানা রোগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে মানবদেহে অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম প্রবেশ করলে ক্যান্সার, টিউমার, আলসার, পুরুষত্বহীনতা, অকাল প্রসব, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, এজমা, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, শিশু ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। অভিযান পরিচালনা করেন র‌্যাব-২’র উপপরিচালক ডঃ মোঃ দিদারুল আলম। তিনি জানান, ওই এলাকায় আর কোন কারখানা যাতে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে ফিড তৈরি করতে না পারে সে বিষয়ে র‌্যাব-২ তৎপর থাকবে।
×