ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর আকবর বাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১২ ডিসেম্বর ২০১৪

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর আকবর বাহিনী

হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ঈমান অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গÑ এই উক্তিটি প্রতিটি বিশ্বাসী অন্তরে অনুরণন সৃষ্টি করে প্রতিক্ষণ। আর এর থেকেই দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জান কুরবান করার চেতনা বিকশিত হয়েছে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা বাংলার স্বাধীনতার জন্য ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মীর জাফর ও জগতশেঠরা ইংরেজদের সঙ্গে আঁতাত করে বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে নবাবকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়, ফলে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়, পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় বাংলাদেশ এবং এদেশের মানুষ। সেই স্বাধীনতা উদ্ধার করতে তখন থেকে সংগ্রাম সূচিত হয় আর তা চলে ২১৪ বছর। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করতে সমর্থ হয় এ দেশের মানুষ। এই যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের মাগুরার শ্রীপুর থানায় আলহাজ মোহাম্মদ আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এক বিশাল মুক্তিবাহিনী। আলহাজ মোহাম্মদ আকবর হোসেন মিয়া ছোটকাল থেকেই আন্দোলনমুখী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ঐ বয়সেই তিনি যুগশ্রেষ্ঠ সূফী পীরে কামেল হযরত মাওলানা শাহ্্সূফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলায়হির একান্ত সাহচর্যে আসেন। পীর সাহেব কেবলা তাকে আদব-আখ্্লাক ও জীবন গড়ার তা’লীম দেন এবং তরীকতের সবকও প্রদান করেন। জনাব আকবর হোসেন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনে শ্রীপুরের ছাত্রদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবি তুলে মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে আমি ও আমার বাহিনী শীর্ষক গ্রন্থে তিনি লিখেছেন : ১৯৫১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ভর্তি হলাম। প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের পাঠানো হলো পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত জেলা শহর কোহাটে। কিন্তু পাকিস্তানীদের অশ্রাব্য গালিগালাজ, অবজ্ঞাসুলভ ব্যবহার আমার মন বিষিয়ে তুলল। অবশেষে ১৯৫৪-তে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে এলাম স্বদেশ ভূমিতে। দেশে ফিরেই দেখি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন চলছে। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নাম সবখানে। ২১ দফার পক্ষে জনগণ রায় দিয়েছে। পাকিস্তানের উর্দুওয়ালাদের আচরণ দেখে এসেছি। মনে মনে পণ করেছি তাদের সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়। দেশে এসে দেখি স্বায়ত্তশাসনের দাবির জোয়ার। আর এই দাবির সঙ্গে আমিও একাত্ম হয়ে গেলাম। এই দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে উন্নীত করার মহান শপথে তখনই আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম। সোহরাওয়ার্দীর প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল। সোহরাওয়ার্দীর নামে মাগুরায় গড়ে উঠেছে মাগুরা হোসেন সোহরাওয়ার্দী কলেজ। সোহরাওয়ার্দীর আকর্ষণেই একদিন আওয়ামী লীগে যোগদান করলাম। আলহাজ আকবর হোসেন মিয়া আওয়ামী লীগে যোগদান করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি এই দলের জন্য ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা চালান। ফলে আওয়ামী লীগ অচিরেই শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। ১৯৬৫ সালে তিনি বিপুল ভোট পেয়ে শ্রীকোল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শ্রীপুর থানায় মোট ৮টি ইউনিয়ন। শ্রীকোল ইউনিয়ন এই থানার সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন। তিনি এই ইউনিয়নকে একটি আদর্শ ইউনিয়নে পরিণত করেন। তাঁর পীর সাহেব হুজুর কিবলার দোয়া নিয়ে শ্রীপুর ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কামারপাড়া সিদ্দিকীয়া আহমদিয়া মাদ্রাসাও তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তাঁর ইউনিয়নের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে প্রভূত অবদান রাখেন। তিনি আকবর চেয়ারম্যান নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতিতে তাঁর অঞ্চলে নেতৃত্ব দান করেছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি তাসাওউফপন্থী এবং একজন সূফী। তিনি বেশ ভূষায় সুন্নতী পোশাক অর্থাৎ ঘুণ্টীদার লম্বা পিরহান, সালোয়ার এবং মাথায় গোল টুপি পরিধান করেন। মুক্তিযুদ্ধকালেও তিনি এই পোশাক পরতেন। তিনি ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের পর পরই নিজ উদ্যোগে মাত্র কয়েকটি রাইফেল সংগ্রহ করে ৫/৬ জন তরুণকে নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। দেখতে দেখতে এই বাহিনীতে এসে যোগ দেয় বিপুলসংখ্যক আর্মি, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং দলে দলে এসে যোগ দেয় উদ্দীপ্ত তরুণরা। এই শক্তিশালী বাহিনীর কথা শুনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী শ্রীপুর অঞ্চলে ঢুকতে সাহস পেত না। কালে ভদ্রে ঢুকলেও ত্বরিত এখান থেকে প্রস্থান করত। তারা আকবর চেয়ারম্যানকে আটক করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং তাঁকে ধরার জন্য পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা করে। কিন্তু আল্লাহর ওপর তাঁর ছিল তাওয়াক্কুল এবং ছিল তাঁর পীরের দোয়া। যে কারণে কোন হুমকিকেই তিনি তোয়াক্কা করতেন না। একবার অপরাহ্ণে সালাতের জন্য গোয়ালপাড়া ক্যানেলের পাশে অস্ত্র রেখে অজু করছিলেন, এই সময় ক্যানেল পাড়ের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর একটি দল চলে যায়। তারা অজু করারত চেয়ারম্যান আকবরকে দেখলেও ইনি যে আকবর চেয়ারম্যান তা বুঝতেই পারেননি। এটা যে আল্লাহর রহমত ও পীর কিবলার দোয়া তা বলাই যায়। আকবর বাহিনীতে বর্তমান লেখকও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই বাহিনী অধিনায়ক আকবর হোসেনের নেতৃত্বে ও দক্ষ পরিচালনায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই বাহিনীর বীরত্বগাথা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। অধিনায়ক আকবর চেয়ারম্যান এক কিংবদন্তি পুরুষে পরিণত হয়েছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আকবর বাহিনীর বীরত্বগাথা ও রণাঙ্গনে বিজয়ের খবর নিয়মিত প্রচারিত হতো এবং শ্রীপুর মুক্ত অঞ্চল ঘোষিত হয়েছিল। আকবর বাহিনী পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে হানাদারদের পরাজিত করেছিল। এই বাহিনী শৈলকুপা থানা, বালিয়াকান্দি থানা দখল করে। ফরিদপুরের রামদিয়ায় চাঁদ খাঁ নামক এক বিহারী নেতা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল। আকবর বাহিনী এই চাঁদ খাঁকে দমন করে এলাকার মানুষকে চাঁদ খাঁর অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে মুক্ত করে। এছাড়া এই বাহিনী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আলফাপুর, মাশালিয়া, খামারপাড়া, কাজলি, গোয়ালপাড়া, নাকোল ইত্যাদি রণাঙ্গনে মুখোমুখি যুদ্ধ করে হানাদারদের পরাজিত করে। এসব ছাড়াও বিনোদপুরে রাজাকারদের শক্তিশালী আস্তানা ধ্বংস করে দেয়। বরিশাট, ইছাখাদাসহ আরও অনেক স্থানে হানাদার বাহিনীর আস্তানায় তীব্র আঘাত হানে। আকবর বাহিনীর কৃতিত্বের কথা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছাড়াও বিবিসিও সম্প্রচার করেছে। কলকাতার পত্র-পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল (৮ ও ৯ সেক্টর)-এর সেনানায়ক মোঃ আবুল মঞ্জুর আকবর বাহিনীকে স্বীকৃতপত্রে বলেন : আপনার ও আপনার বাহিনীর উদ্যম, উৎসাহ ও বীরোচিত কার্যকলাপের পরিচয় পেয়ে আমি সানন্দে আপনার বাহিনীকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অনুমোদিত শাখা বলে সনদ দান করলাম।... মুক্তিযুদ্ধকালে ক্যাপ্টেন আবদুল ওহ্্হাব ছিলেন ৮ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার (বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল)। তিনি লিখেছেন : নয় মাসে আকবর হোসেন সাহেবের রাইফেল তাঁর স্কন্ধ থেকে নামেনি। তাঁর মতো সাহসী দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা দেশে বিরল। ৭ ডিসেম্বর মাগুরা হানাদারমুক্ত হয়। ৬ ডিসেম্বর রাতে জেনারেল অরোরা মাগুরায় অবতরণ করে প্রথমেই আকবর সাহেবের খোঁজ করেন। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
×