ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ঢাকায় বেগম রোকেয়া কি দেখলেন

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১২ ডিসেম্বর ২০১৪

ঢাকায় বেগম রোকেয়া কি দেখলেন

‘তাহলে কতো দূর এগোলো নারী?’ দিব্যরথে চড়ে শতবর্ষ পেরিয়ে নিজ দেশে এসে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন তিনি। উত্তর তো অজানা। দৃশ্যপটও অচেনা। তবু কৌতূহল চশমার আড়ালে ঢাকা দু’চোখে। তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ মুগ্ধ হলেন। তাঁর চোখে পড়লো এক দেয়াল লিখন, ‘শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্বালো।’ এই আলোই তো জ্বালাতে চেয়েছিলেন জীবনভর। তিনি খানিকটা আশ্বস্ত হলেন এই ভেবে, যাক, শিক্ষার আলো তাহলে ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। তিনি বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে থমকে গেলেন। ছোট ছোট প্রজাপতির মতো মেয়েরা ব্যাগ কাঁধে মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু একি দেখছেন তিনি ! মায়েদের অনেকেই বোরকায় আবৃত । স্কুলের শিক্ষিকাদের কারও কারও একই অবস্থা। উঁচু ক্লাসের মেয়েদের পরনেও হিজাব কিংবা বোরকা। এসব দেখে বিস্ময়ে হতবাক ‘অবরোধবাসিনী’। তিনি ভাবলেন, কী চেয়েছিলাম আর কী হলো! তাঁর মনে পড়লো, ১৯২৯ সালের ২৮ জুনের একটি ঘটনা। নয় বছর বয়সী বালিকা হীরা। মোটর বাস তার বাড়ির গলির ভেতর যায় না বলে ‘বোরকা’ পরে চাকরানীর সঙ্গে হেঁটে ঘরে ফিরে। আবার সেই বোরকায় নেই চোখ। তা না থাকায় বালিকাটি ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। চাকরানী কোলের কাছে ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। দেখতে না পাওয়ায় কখনও বিড়ালের গায়ে পড়ে, কখনও হোঁচট খায়। একবার এক চায়ের কাপ বহনকারীর গায়ে ধাক্কা লেগে চা পড়ে যায়Ñসে নিয়ে হুলস্থূল। বুঝলেন, এখনকার মেয়েদের বোরকায় শুধু চোখ রয়েছে। বোরকার আবডালে বন্দী হলেও সামনে দেখতে পায়। নিউমার্কেটের প্রবেশপথে থমকে দাঁড়ালেন। রমণী-কিশোরীরা ঘুরছে পুরুষের পাশাপাশি। কেনাকাটাও করছে। কিন্তু অধিকাংশ রমণীরই মুখ দেখা যায় না। বোরকার আবরণে বন্দী। শুধু চোখ দুটো পিটপিট করে। কিশোরীদের অবয়বও ঢাকা পড়ে গেছে হিজাবে। উল্টোদিকে তাকাতেই দেখেন সিনেমা হলের বিলবোর্ড। তাতে স্বল্পবসনা হাস্যোজ্জ্বল নারী। আবারও বিমূঢ় হয়ে পড়েন তিনি। আজিমপুরের দিকে চোখ যেতেই তিনি দেখতে পেলেন টিফিন কেরিয়ার হাতে সারি সারি বস্ত্র বালিকা উর্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে। ওরা কোথায় যাচ্ছে? ওরা পোশাক কারখানার দিকে ধাবমান। বুকভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। আহা! এমনটাই তো চেয়েছিলেন। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও কর্মক্ষেত্রে ছুটে চলেছে। ঘুরতে ঘুরতে তিনি প্রেসক্লাবে গেলেন। সেখানে চলছে গোলটেবিল বৈঠক। তিনি বৈঠকে ঢুকে পড়লেন। বেগম রোকেয়া দিবস পালনকারী নারীরা আলোচনায় মগ্ন। তাদের কয়েকজন আবার হিজাব পরিহিত। ক্ষুব্ধ কণ্ঠ সবার। তাঁরা বলছেন কর্মক্ষেত্রে তাদের বৈষমের কথা। শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালতে, ক্ষেতে-খামারে, প্রশাসনে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করলেও তাদের প্রতি নিপীড়ন কমেনি। শুধু তাই নয় কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের সমান বেতন বা সমান মজুরি দেয়া হয় না। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বাড়ছে। ভয়াবহ মাত্রার নারী নির্যাতন এখনও বন্ধ হয়নি। গণধর্ষণ, নারী নির্যাতনের সংখ্যার মাত্রাও বাড়ছে। যৌতুকের জন্য ঘরে ঘরে নারী নির্যাতিত হচ্ছে। এ্যাসিডে ঝলসে দেয়া হচ্ছে। বাল্যবিবাহ অবাধে চলছে। নারীর ব্যক্তি অধিকার নেই। বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদেও নেই অধিকার। গোলটেবিল বৈঠকে এসব শুনতে শুনতে তার কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। ক্লাবের পাঠাগারে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতেই দেখলেন, এক বছরে ৪ হাজার নারী নির্যাতনের ঘটনা। চট্টগ্রামের এক হুজুর মেয়েদের তুলনা করেছেন তেঁতুলের সঙ্গে। পুরুষের লালা ঝরার কুৎসিত কাহিনী বয়ানের পাশাপাশি দাবিও সেই হুজুরদের, মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি-বাকরি বন্ধ করতে হবে। বোরকা পরতে হবে। গান-বাজনা করতে পারবে না। এসব পড়তে পড়তে তাঁর প্রায় জ্ঞান হারাবার অবস্থা। এর মধ্যে তাঁর বোধোদয় জাগে। শতবর্ষ আগে তিনি ‘সুলতানার স্বপ্ন’র মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার কি কোন প্রতিফলন ঘটছে? তিনি তাঁর সময়ে মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদতা হতে নারীকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। অবরোধবাসিনী নারীকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার পথ দেখিয়েছিলেন- তাঁর স্বপ্ন কি তবে ঘূর্ণি পাকে ঘুরছে? এসব দেখে শুনে তাঁর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। তিনি মাথা ধরে বসে পড়লেন। জ্ঞান হারাবার আগে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, একুশ শতকেও মুক্তি হলো না নারীর, তবে আর কবে হবে?
×