ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের অভিভাবক

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১২ ডিসেম্বর ২০১৪

আমাদের অভিভাবক

প্রবাসে প্রতিদিনের হাজার কর্মব্যস্ততার মাঝেও যে মানুষটির সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে কথা হয়, তিনি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। প্রতিদিনের এই রুটিন ভঙ্গ হওয়ার নয়। নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যান। বাঙালীর আহ্বান তিনি উপেক্ষা করেন না। যেখানেই যাবেন তিনি, সেখানেই রোজ সকালে তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলার রুটিন থেকে সরে আসার জো নেই। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অন্যদের কাছে নানাভাবে পরিচিত। কিন্তু আমার কাছে তিনি এক অমোঘ আকর্ষণ। আমি জানি পরিচিত কেউই এই আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারেন না। দূরে বসেও তাঁর সান্নিধ্য পেতে তাই প্রতিদিনের দূরআলাপন। যত দূর থেকেই তাঁর সঙ্গে কথা বলি না কেন, মনে হয় তিনি সামনেই বসে আছেন। তাঁর প্রতিটি বাক্য থেকে যে অপার স্নেহ ঝরে পড়ে, তার তুলনা কিসের সঙ্গে দেব! ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় দুপুরে তিনি যখন হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসা, তখনও কথা হয়েছে। আজ পর্যন্ত প্রতিদিন একাধিকবার কথা হয়েছে। কথা হবে প্রতিদিন। প্রতিদিন টেলিফোনে কথা বলেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলি। আমার সৌভাগ্য আমি তাঁর স্নেহ ও ভালবাসা পেয়েছি। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক যে কোন প্রয়োজনে পেয়েছি তাঁর উপদেশ। তিনি আমাদের পরিচিতজন শুধু নন, আমাদের অভিভাবক। আমাদের সবার চেনা ও অতিপ্রিয় গাফ্ফার ভাই এখন থাকেন লন্ডনে। প্রবাসী অনেকের সঙ্গেই দেশের যোগাযোগ দিনে দিনে কমে আসে। কেউ কেউ কালে-ভদ্রে দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ব্যতিক্রম গাফ্ফার ভাই। লন্ডনে থাকলেও তাঁর মনটি কিন্তু পড়ে থাকে দেশে। স্বদেশের খবরের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত তিনি উদগ্রীব থাকেন। নিজে প্রতিদিন ফোনে কথা বলেন দেশে। তাঁর নিজস্ব একটি বলয় আছে, সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তিনি। দেশের মাটির প্রতি তাঁর এই আকুতি বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ বয়সেই তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তাঁর স্কুল জীবনেই। স্কুলের পাঠ নিতে নিতেই নিয়েছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির পাঠ। আধুনিক মনস্ক এই মানুষটি আজও মননে প্রগতিশীল। ১৯৫২ সালে কলম ধরেছিলেন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করেছিলেন। আজও সমান প্রতিবাদী তিনি। যখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়, দেশের অপরাজনীতি যখন অপপ্রচারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলম তখন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন একটি কবিতা লিখেই। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম সোপান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তরুণ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকেও স্পর্শ করেছিল। লিখেছিলেন এক অমর কবিতা। অমর সুরকার আলতাফ মাহমুদের সুরে তা আজ গীত হয় বিশ্বজুড়ে একুশের প্রভাতফেরির গান হিসেবে। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এভাবেই নিজেকে যুক্ত করে ফেলেছিলেন তিনি। বাঙালী চিরদিন স্মরণ করবে এই গানটি। আর স্মরণ করবে এই গানের গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকেও। সে কারণেই তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। যতদিন বাঙালী জাতি টিকে থাকবে, একুশের প্রভাতফেরি হবে। প্রভাতফেরিতে গীত হবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। আজ সারা বিশ্বে গানটি গাওয়া হয়। বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে গানটি। গাওয়া হয়েছে। বেরিয়েছে রেকর্ড। বাঙালীর জন্য এ এক অনন্য সম্মান। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিকে এই অনন্য সম্মান এনে দিয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। সেলিব্রিটি সাংবাদিক বললে কম বলা হয় তাঁকে। সাংবাদিকতাকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন তিনি। যে নিরস কলাম কেবল সমাজের বিশেষ এক পাঠকদের জন্য মনে করা হতো, তাঁকে নিয়ে গেছেন সাধারণের কাতারে। সংবাদপত্রের গুরুগম্ভীর আলোচনার বিষয়কে তিনি সংবাদ-সাহিত্যের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এখানেই কৃতিত্ব তাঁর। বায়ান্নতে যেমন প্রতিবাদী হয়েছিলেন তিনি, তেমনি প্রতিবাদে কলম ধরেছিলেন একাত্তরেও। একাত্তরের কীর্তিমান কলমযোদ্ধা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধে যখন দেশের মুক্তিপাগল মানুষ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রত, তখন আরেক লড়াই চলছিল। সে লড়াইয়ে শামিল ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে কলম সৈনিকের ভূমিকার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে ‘মোটিভেটর’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখনও প্রতিবাদী তিনি। তাঁর কলামে প্রতিবাদ করেন সব অনিয়মের বিরুদ্ধে। বর্তমান প্রজšে§র কাছে যে পরিচিতি তাঁর, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী শুধুই সাংবাদিক, কলাম লেখক নন। একুশের অমর গানের রচয়িতা, কিংবা সংবাদ সাহিত্যের কিংবদন্তিÑ শুধু এই পরিচয়ের সীমায় আবদ্ধ রাখা যায় না তাঁকে। নন্দিত কথাশিল্পীও তিনি। একাধারে লিখেছেন, ছোটগল্প, উপন্যাস, গান, কবিতা। তাঁর পাঠকনন্দিত ছোটগল্পের বই ‘সম্রাটের ছবি’ পায় ইউনেস্কো পুরস্কার। শুধু এই এক পুরস্কার নয়, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ভূষিত হয়েছেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কারেও। পেয়েছেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সবচেয়ে বড় পুরস্কার তাঁর পাঠকপ্রিয়তা। বিদেশে অবস্থান করেও বাংলাদেশের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় এই কলাম লেখক নিরলস লিখে চলেছেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠসহ কালের কণ্ঠ, ইত্তেফাক, সমকাল, যুগান্তর ও ইংরেজী দৈনিক দ্য ইনডিপেন্ডেন্টে নিয়মিত কলাম লিখছেন। কলকাতার দৈনিক বাংলা স্টেটসম্যানসহ লন্ডনের বাংলা সাপ্তাহিক জনমতেও নিয়মিত লেখেন। অসাধারণ এক কথক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলামের বড় আকর্ষণ সমসাময়িকতা। অসামান্য দক্ষতায় শব্দের বুননে তিনি পাঠককে টেনে নিয়ে যান শুরু থেকে শেষ শব্দটি পর্যন্ত। আগেই বলেছি দেশ সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তিনি যে কেবল লেখার দায়েই লিখছেন তা নয়। তিনি লেখাকে তাঁর দায়িত্ব হিসেবেই নিয়েছেন। প্রতিদিনের কলামের পাশাপাশি তাঁর সাক্ষাতকারের ভেতর দিয়েও তিনি এই তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘দেশের সাধারণ মানুষ বলতে আগে আমরা মনে করতাম ধনী ও দরিদ্র। বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশে এখন একটি বিশাল নব্য ধনী শ্রেণী তৈরি হয়েছে। মধ্যবিত্ত একটি ক্ষুদ্র অংশের খুবই সমৃদ্ধি হয়েছে। বাকি অংশ অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে। গ্রামাঞ্চলে একটি সচ্ছল কৃষক ও কৃষি শ্রমিকশ্রেণী তৈরি হয়েছে। নারীর বন্দিত্ব দশা অনেকটা কমেছে। অর্থাৎ দেশের মানুষের ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। কিন্তু মন্দ দিকটাই বেশি। সাধারণভাবে বলতে গেলে দেশের মানুষ ভালো নেই। এর বড় কারণ, সামাজিক অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক ব্যাপক দুর্নীতি। নারীমুক্তি ঘটেছে কিন্তু বহুগুণ বেড়েছে নারী নির্যাতন। কৃষি শ্রমিকদের আয় বেড়েছে কিন্তু পণ্যমূল্যের অসম্ভব ঊর্ধ্বগতি তাদের সে আয়কে স্বস্তিদায়ক করতে পারছে না। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণী অসম্ভব চাপের ভেতরে পিষ্ট। তারা নির্ধারিত আয় দ্বারা জীবনধারণ করতে পারছে না। ফলে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে হু হু করে। সমাজের শীর্ষ থেকে পাদদেশÑসর্বস্তরে দুর্নীতি বিরাজিত। কোনক্ষেত্রেই সামাজিক কোন মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা নেই। আইনশৃঙ্খলার প্রতি কারও কোন শ্রদ্ধা নেই। ফলে ভয়াবহ এক নৈরাজ্যের ভেতর দেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। একটি কালো টাকাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এবং সবচেয়ে ভাল আছে এই কালো টাকানির্ভর নব্য ধনী সম্প্রদায়। সরকার, সংসদ, আদালত, মিডিয়া, এমনকি উপাসনালয় পর্যন্ত এই কালোহাতের থাবা বিস্তার লাভ করেছে। দেশে একটি সমাজ-বিপ্লব প্রয়োজন। তা না হলে এই অধোগতি থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে না।’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে সবাই জানেন। কিন্তু দেশ সম্পর্কে এই উচ্চারণ কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আজকের দিনে যখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে, অপরাজনীতি যখন সমাজকে গ্রাস করতে চাইছে, তখন তাঁর মতো গর্জে ওঠা একজন মানুষকে খুব প্রয়োজন। আজ তাঁর ৮০তম জন্মবার্ষিকী। জন্মবর্ষিকীতে তাঁকে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। শতায়ু হোন তিনিÑ আজকের দিনে আমাদের একটাই চাওয়া। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক
×