ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভারতে জেএমবির অর্থের বড় উৎস জামায়াত

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১২ ডিসেম্বর ২০১৪

ভারতে জেএমবির অর্থের বড় উৎস জামায়াত

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামী বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢেলেছে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গী তৎপরতায়। জেএমবি জঙ্গীদের টাকার উৎস ও সেই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে তার খোঁজে নেমে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য আহমদ হাসান ইমরানের সঙ্গে যোগসূত্র মিলেছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। গোয়েন্দারা তদন্তে পেয়েছেন, সাংসদ ইমরান জেএমবি ও জামায়াতের বিপুল পরিমাণ টাকা মেরে দিয়েছে। জেএমবির নেতা শাহনুর আলম ডাক্তার অসমের বরপেটায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তার দেয়া জবানবন্দীতে এই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। জঙ্গী তৎপরতা, মৌলবাদী ও জামায়াতী ভাবধারা প্রচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর বিপুল পরিমাণ টাকা পাঠানোর বিষয়টি ভারতের তদন্তকারী গোয়েন্দারা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের অবহিত করবে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, জামায়াতে ইসলামী পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের জেএমবির জঙ্গীদের কাছে কিভাবে অর্থ পাঠিয়েছে সে বিষয়ে অসমে গ্রেফতারকৃত শাহনুর আলম ডাক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ভারতের তদন্তকারী পুলিশ ও এনআইএ। এনআইএ এবং অসম পুলিশ তাকে জেরা করে ইতোমধ্যেই অসম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হচ্ছে, ভারতে নিষিদ্ধ স্টুডেন্ট মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়ার (সিমি) সদস্য। সিমির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তৃণমূলের সাংসদ হাসান আহমেদ ইমরান। গ্রেফতারকৃত সিমির সদস্যদের মারফতই বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে আসা টাকা পেত তৃণমূলের সাংসদ হাসান আহমেদ ইমরান। তদন্তকারীদের দাবি, বাংলাদেশ থেকে অসম হয়ে পশ্চিমবঙ্গে জেএমবি মডিউলের কাছে যে টাকা আসত শাহনুর ওরফে ডাক্তার ছিল তার যোগানদার। আর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য আহমদ হাসান ইমরানের সঙ্গে যোগসূত্র মিলেছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্র বলেছেন, ডাক্তার শাহনুর আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ৪ জনের নাম পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা এক সময়ে সিমির (স্টুডেন্ট ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া) সঙ্গে যুক্ত ছিল। মূলত বাংলাদেশ থেকে আসা বিপুল টাকা নিজেদের হেফাজতে রেখে বিলিবণ্টন করত তারাই। গ্রেফতারকৃতদের কাছে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আহমদ হাসান ইমরানের। তৃণমূলের এই সাংসদ নিজে সিমির প্রাক্তন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সিমির সভাপতি থাকার সূত্রেই অসমের এই সন্দেহভাজনদের সঙ্গে ইমরানের পরিচিতি ছিল। পরিচিতির সুবাদেই তাদের কাছে ছিল তার নিয়মিত যাতায়াত। সাংসদ ইমরান তার নিজের সংবাদপত্র ‘কলম’কে সামনে রেখে অর্থ নিয়েছেন বলে তদন্তকারীদের দাবি। তদন্তকারী সূত্রে জানা গেছে, ইমরানের ‘কলম’ সংবাদপত্রে বিপুল অর্থ ঢেলেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। নিয়মিত কাগজ চালানো ও বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসা জঙ্গীদের আশ্রয় দেয়ার জন্যই অসম থেকে কয়েক দফায় টাকা নিয়ে এসেছেন ইমরান। জামায়াতে ইসলামী তাদের জামায়াতী ভাবধারা, মৌলবাদী ও জঙ্গী তৎপরতা চালানোর জন্য ইমরানকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। তদন্তকারী সংস্থা জানতে পেরেছে, স্টুডেন্ট ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়াÑসিমির অফিসেই ছিল ইমরানের ‘কলম’ সংবাদপত্রটির অফিস। জঙ্গী কার্যকলাপের জন্য সিমি নিষিদ্ধ হয়। তারপরও ইমরান পত্রিকাটি একই রেজিস্ট্রেশন নম্বরে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশ করতে থাকেন। অসমেই ইমরানের শ্বশুরবাড়ি বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। শুধু তাই নয়, প্রাক্তন এই সিমি নেতা তৃণমূল সাংসদ ইমরানের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আদতে বাংলাদেশী। বাংলাদেশে তাঁর শ্বশুরবাড়ির তরফের আত্মীয়দের অনেকেই জামায়াতে ইসলামী ও তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের মাধ্যমেও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে টাকা সংগ্রহ করেছেন ইমরান। সাংসদ হওয়ার আগে ইমরান প্রতিবছর ঈদের সময়ে বাংলাদেশে যেতেন। বাংলাদেশে গিয়ে তিনি জামায়াত নেতা ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল টাকা সংগ্রহ করতেন। সংগ্রহ করা টাকা অসমের পথেই কলকাতায় আনা হতো। বাংলাদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ আইবির ফাইলে ॥ বাংলাদেশ থেকে বেআইনীভাবে অর্থ সংগ্রহের অভিযোগটি ইমরানকে নিয়ে তৈরি করা কেন্দ্রীয় আইবির ফাইলেও রয়েছে বলে দাবি করেছে গোয়েন্দারা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যসভায় দলীয় প্রার্থী হিসেবে ইমরানের নাম ঘোষণা করার পর দিল্লী থেকে উড়ে আসেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব অনিল গোস্বামী। নবান্নে এসে ইমরানের বিরুদ্ধে তৈরি করা ফাইলই মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব। তখন কিন্তু মমতা সিদ্ধান্ত বদলাননি। এখন বাংলাদেশ থেকে দফায় দফায় টাকা আনার বিষয়ে তথ্য পাওয়ার পরে তৃণমূলের এই সাংসদের বিরুদ্ধে ফেমায় (ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট এ্যাক্ট) অভিযোগ দায়ের করার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। সারদা কেলেঙ্কারির ঘটনার তদন্তে জেরার জন্য ইতোমধ্যেই ইমরানকে ডেকেছে সিবিআই। জঙ্গী জিহাদীর অর্থেও ভাগ বসিয়েছে ॥ জেএমবি জঙ্গীদের টাকার উৎস ও সেই টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে তার খোঁজে নেমেছে তদন্তকারীরা। অসমে গ্রেফতারকৃত ডাক্তার শাহনুরের দেয়া তথ্য মতে গ্রেফতারকৃত অসমে ধৃত প্রাক্তন সিমি নেতাদের জেরা করে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, তারা যে ইমরানকে টাকা দিয়েছেন সেই টাকা তিনি ঠিকমতো জঙ্গী, জিহাদী ও মৌলবাদী ভাবধারার কাজে ব্যবহার করেননি। এজন্য তার (ইমরানের) ওপর বিরক্ত তারা। তাঁদের কাছ থেকে নেয়া টাকার কতটা তিনি কাগজ চালানোর কাজে ব্যবহার করেছেন ও জঙ্গীদের আশ্রয় দেয়ার কাজে কত টাকা ব্যবহার করেছেন, আর কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন তা নিয়েও ইমরানের ‘সিমি-বন্ধুরা’ সন্দিহান। টাকা নেয়ার বিনিময়ে যে মাত্রায় জেহাদী প্রচার করা উচিত ছিল, ইমরান তাঁর সংবাদপত্রে তা করতেন না। অসমে সিমির প্রাক্তন নেতারা এনআইএর কাছে নালিশ করেছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রের দাবি। বিভিন্ন জনের কাছে থেকে টাকা নেয়ার ফলে ইমরান তাঁর কাগজে কাউকেই চটাতে চাইতেন না। তবে একেবারেই প্রচার করতেন না তা নয়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা সংবাদপত্র ‘কলম’-এর ফাইল সংগ্রহ করে তাতে জামায়াতে ইসলামী ও মৌলবাদী প্রচারের বহু নমুনা পেয়েছেন। তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য আহমদ হাসান ইমরানের সঙ্গে যোগসূত্র মিলেছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। অভিযোগগুলো নিয়ে ইমরানের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বহুল প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করার আগে ফোনে যোগাযোগ করা হলে কোন উত্তর দেননি ইমরান। কে এই জাহিদ ॥ জেএমবির নেতা অসমে গ্রেফতারকৃত ডাক্তার শাহনুরের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী খোঁজা হচ্ছে আরেক জেএমবির জঙ্গী নেতা জাহিদকে। পশ্চিমবঙ্গের আগে থেকেই জেএমবির অসম মডিউলটি সক্রিয় রয়েছে। অসমের শাহনুরকে গ্রেফতারের পর এখন জাহিদ নামে আরও এক জঙ্গীরও খোঁজ চালাচ্ছে এনআইএ। শাহনুর জানিয়েছে, জাহিদই তাকে জেএমবিতে এনেছে। বরপেটার এক তরুণীকে বিয়ে করে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছে জাহিদ। বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর থেকেই সস্ত্রীক নিরুদ্দেশ সে। সে বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশ মনে করছে। বাংলাদেশ থেকে অসম হয়ে পশ্চিমবঙ্গে অর্থ আসার বিষয়টিতেও জাহিদের যোগাযোগ পাওয়া গিয়েছে বলে তদন্তকারীদের দবি। যেভাবে জেএমবি ঘাঁটি গেড়েছে : জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর জঙ্গীরা প্রথমে একটি জেলার একটি মাদ্রাসাকে বেছে নিত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে জেএমবির ঘাঁটি গেড়ে বসা নিয়ে তদন্ত করেছে তদন্ত সংস্থা এনআইএ। প্রথমে জেহাদী শিক্ষার পাঠ, মগজধোলাই ও শেষমেশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরি শেখানো হতো। একটি ডেরাকে কেন্দ্র করেই জেলার অন্যান্য অংশে জাল বিছানো হতো। যেমনটা প্রথমে মকিমনগর ও পরে শিমুলিয়া মাদ্রাসায় হয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তাঁরা জেনেছেন, কোন মাদ্রাসাকে বেছে নেয়ার সময়ে তার ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়টি মাথায় রাখা হতো। জেএমবির জঙ্গীরা প্রথমে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলে মুর্শিদাবাদের লালগোলার মকিমনগর মাদ্রাসায়। তারপর দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলে বর্ধমানের মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসায়। কিন্তু তিন নম্বর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার ছক ছিল ডোমকলে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে অনেক আগেই অসমে জেএমবির জঙ্গী ঘাঁটি গাড়া হয়। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় চোখ খুলে যাওয়ার মতো তথ্য পায় গোয়েন্দারা।
×