ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রণজিৎ বিশ্বাস

উহাদের ভাজন বিভাজন

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৪

উহাদের ভাজন বিভাজন

কোন দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ হয়, মানুষ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বড় এবং খুব বড় ভাগটি থাকে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, এদের মধ্যে কেউ বীর, কেউ মহাবীর; ছোট ও খুব ছোট, পদতলে পিষে ফেলবার মতো ছোট ভাগটি থাকে পরাধীনতার পক্ষে ও আপন দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। এরা যুদ্ধাপরাধ করে, মানবতাবিরোধী কাজ করে। এরা কুলাঙ্গার, এরা কীট ও কখনও কখনও কীটানুকীট। এরা ভাইবন্ধুপ্রতিবেশীদের বুকেপিঠে গুলি ছুরি চালায়, মাথায় লাঠি বসায়। এরা বিদেশী প্রভুদের পা, পাদুকা ও পাদুকাতলের আবর্জনা চাটে এবং তাদের নাজায়েজ আওলাদ-এর মতো আচরণ করে। কোন দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় পায়, তাদের মধ্যেও দু’ভাগ। জেন্যুইন মুক্তিযোদ্ধা ও বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা। বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধারা আবার প্রকারে প্রকারে দু’প্রকার। কেউ বিক্রীত ও কেউ বিকৃত। যাঁরা বিক্রীত বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা, তারা দু’প্রকার। অর্থবিক্রীত ও পদবিক্রীত। যারা বিকৃত বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা, তারাও দু’প্রকার। স্বল্পবিকৃত ও বিপুলবিকৃত। বিপুলবিকৃত বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও দুটি ভাগ আছে। স্বল্পসাম্প্রদায়িক ও গল্পসাম্প্রদায়িক। যাদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ভয়াবহ কিংবা অবিশ্বাস্য কোন গল্পের মতো, যাদের সাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিচারবুদ্ধি বানোয়াট কোন গল্পকেও হার মানায়। তারা গল্পসাম্প্রদায়িক। এই বাইচান্স ও গল্পসাম্প্রদায়িক টাইপের বিকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুটি শ্রেণী আছে। নগ্নসাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক। নগ্নসাম্প্রদায়িকদের চেনা যায়, তাদের মোকাবেলার জন্য শস্ত্র শানানো যায়, কিন্তু যারা তাদের চেয়েও পাঁচশ’ সাঁইত্রিশ গুণ কদর্য ও তিনশ’ উনিশ গুণ ‘ডার্টি’ ও ডেট্রিমেন্টাল অর্থাৎ অপরিচ্ছন্ন ও ক্ষতিকর এবং সবসময় আপাত আধুনিক ভাব নিয়ে সদাসর্বদা ছদ্মাবরণে থাকে, তারা ছদ্মসাম্প্রদায়িক। এরাই দেশ ও সমাজের সবেচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে এবং এখনও করে চলেছে। নগ্নসাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক ন্যাচারের ও বিকৃত বৈশিষ্ট্যের বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধাদের একটি আচরণগত ঐক্য আছে। যেমন, এরা মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের খেয়ে না খেয়ে সাপোর্ট করে, এরা ইডিয়ট ও ইডিয়টস্য ইডিয়ট-এর মতো চার রকমের আচরণ করে। সম্প্রীতি সৌহার্দ্যে ও প্রীতিতে প্রশ্রয়েপ্রেমে ভেজানো ডোবানো ও জবজবানো অবস্থায় কোলে বসায়, বুকে টানে, কাঁধে চড়ায় ও মাথায় তোলে। কখনোই ওরা বুঝতে পারে না বুকে টানা কোলে বসানো কাঁধে চড়ানো ও মাথায় তোলা ক্রিয়েটিভ ক্রিয়েচারগুলোই ওদের খুবলেখাবলে খেয়ে নেবে, তাদের খোকলা ফোকলা ও চিমসে বানিয়ে রাস্তার ’পরে ছেড়ে দেবে। এই অতিপ্রাকৃত বৈশিষ্ট্যের জন্যই ওরা কেউ ইডিয়ট ও কেউ ইডিয়টস্য ইডিয়ট। এরা বুঝতেই পারে না, যে দেশের স্বাধীনতার এত বড় বেনিফিশিয়ারি হয়ে গেলাম এতবড় কালপ্রিট ও গাদ্দার ও দুশমন এবং দুশমনস্য দুশমন হওয়ার পরও, সে দেশ সমাজ ও দেশের মানুষের সঙ্গে আর বেইমানি করা উচিত নয় আমাদের। তারা বোঝে না মানুষের অশ্রদ্ধা, ঘৃণা, বিবমিষা ও অভিশাপের মাঝে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা যায় না। তারা বোঝে না, সন্তানদের ব্যবস্থাপত্রের ইতিহাস পড়িয়ে ও ধৌতমস্তিষ্ক কানা বাইসন বানিয়ে বেশি দিন রাখা যায় না। ওরা একদিন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে ও মতলববাজ নষ্টগুরুদের গুঁতিয়ে শেষ করে দেয়, শেষ করার আগে নাভিবরাবর শিং ঢুকিয়ে পেট ফেঁড়ে ও বক্ষ চিরে দেয়। যারা বোঝে, সাবধান হয়; যারা বোঝে না চিৎ হয়ে পড়ে থাকে। তখন তাদের শত্রু হাসে, মিত্র কাঁদে, ভ্রষ্ট মাথার নষ্ট কাজের কোনটিতেই সাফল্য আসে না, যথাসময়ে যথাপ্রাপ্য বুঝে নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শস্নিগ্ধ স্বচ্ছ শুদ্ধ সুবাসিত ও পবিত্র পথটি থেকে তাদের সরে দাঁড়াতে হয়, মানুষকে তাদের দেহখ-ের ওপর মাড়াতে দিতে হয়। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×