ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডেটলাইন ॥ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৪

ডেটলাইন ॥ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভোর ছয়টা। চারদিকে ঘন কুয়াশা ও অন্ধকার ভেদ করে বিজয়ের টক্টকে রক্তিম সূর্য যখন ক্রমে মাথা উঁচু করে উঠে আসছে, তখন মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা ঢাকার সন্নিকটে মিরপুর ব্রিজের উত্তর পাশে আমিনবাজারে রাস্তায় খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি করছেন। সঙ্গে রয়েছেন কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান বাঘা সিদ্দিকী, শিখ লাইট ইনফ্যানট্রির হরদেব সিং ক্লার ও ভারতীয় ১৩ গার্ডসের সন্তু সিং। মিরপুর ব্রিজের সম্পূর্ণ কন্ট্রোল তখন মিত্রবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নের হাতে। এই কমান্ডো বাহিনীকে ১১ ডিসেম্বর মধ্য রাতে টাঙ্গাইলের কাছে ‘এয়ার স্ট্রিপে’ ভারতীয় ট্রান্সপোর্ট প্লেন থেকে প্যারাস্যুটযোগে ৩.৭ ইঞ্চি কামান ও প্রচুর অস্ত্রসহ নামানো হয়। তখন টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে অবস্থান করছিলেন পলায়নরত বিশাল বাহিনীসহ পাকিস্তানী ৯৩ ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার কাদির। তিনি খবর পেলেন, তাঁদের সাহায্যের জন্য চীনা সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্রসহ অবতরণ করছে। খবরটা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভুল। ভুল ভাঙ্গার পর ব্রিগেডিয়ার কাদির ত্বরিত গতিতে তার বিশাল বাহিনী নিয়ে পালিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হলে পথের মধ্যে তাদের গতিরোধ করে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয় কাদেরীয়া বাহিনী। ব্রিগেডিয়ার কাদির গ্রেফতার হন। এরপর কাদেরীয়া বাহিনী ও কমান্ডো বাহিনী কালিয়াকৈর ও সাভার হয়ে মিরপুর ব্রিজের কাছে আসেন। খবর ছিল মিত্রবাহিনী যেন মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে। এজন্য পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর কড়া নির্দেশ ছিল, যেমন করেই হোক মিরপুর নিজেদের দখলে রাখতে প্রয়োজনে ব্রিজ উড়িয়ে দিতে হবে। এই গোপন খবর মিত্রবাহিনীর কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডো বাহিনী মিরপুর ব্রিজের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নেয়। এর পরও পাকিস্তান বাহিনী মেজর সালামতের নেতৃত্বে অনেকবার বৃথা চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কমান্ডো বাহিনীর ব্যাটালিয়ন প্রচণ্ড আক্রমণে কিছু সৈন্যের লাশ ফেলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মেজর জেনারেল নাগরা একটা বিষয়ে খুবই চিন্তিত যে ভারতীয় বাহিনী প্রধান জেনারেল মানেক’শ রেডিও মারফত জেনারেল নিয়াজীকে তার সম্পূর্ণ বাহিনীসহ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, এর পরও যদি আমার আবেদন মোতাবেক আপনি যদি পুরো বাহিনীসহ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণ না করেন, তাহলে আমার মিত্রবাহিনীকে জলে, স্থলে ও আকাশে পূর্ণোদ্যমে ঢাকার বুকে আঘাত হানার জন্য নির্দেশ দিতে আমি বাধ্য হব। তিনি এই আহ্বান উর্দু ও ইংরেজীতে প্রচারপত্র আকারে বিমানযোগে সারাবাংলাদেশে বিতরণ করেন। মেজর জেনারেল নাগরা মিরপুর ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে বার বার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। ঘড়িতে তখন সকাল সাতটা। এর মধ্যে ব্রিগেডিয়ার ক্লার কাছে খবর এলো জেনারেল নিয়াজী বিভিন্ন সেক্টরে ও ঘাঁটিতে সকাল ছয়টা থেকে যুদ্ধ বন্ধ করার ম্যাসেজ পাঠাছেন। সেই ম্যাসেজ ইন্টারসেপ্ট করা হয়েছে। আশাপ্রদ খবরগুলো মেজর জেনারেল নাগরা কাদেরীয়া বাহিনী প্রধান টাইগার কাদের সিদ্দিকী, হরদেব সিং ক্লার ও সন্তু সিং সলাপরামর্শ করতে বসলেন। ঠিক হলো এই মুহূর্তেই জেনারেল নিয়াজীর কাছে মিত্রবাহিনীর তরফ থেকে চিঠি দিয়ে দূত পাঠাতে হবে। মেজর জেনারেল নাগরা ছোট্ট কাগজে জেনারেল নিয়াজীকে একটি বার্তা লিখে কমান্ডো ব্যাটালিয়নের দু’জন অফিসারকে দিয়ে জীপে একটি সাদা পতাকা লাগিয়ে জেনারেল নিয়াজীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বার্তাতে লেখা ছিলÑ “প্রিয় নিয়াজী আমার পুরো বাহিনীসহ আমি মিরপুর ব্রিজের ওপর। আপনি জানেন, ঘটনার পরিসমাপ্তি হয়েছে। পরামর্শ হচ্ছে এখন আপনি আপনার পুরো বাহিনীসহ আমার কাছে আত্মসমর্পণ করুন। সেক্ষেত্রে আমরা আপনারদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেব। শীঘ্রই আপনাদের প্রতিনিধি পাঠান, নাগরা। মেজর জেনারেল নাগরা জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিন চার বছর আগে মেজর জেনারেল নাগরা যখন ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাসে মিলিটারি এ্যাটাচি, তখন থেকে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে তার পরিচয়। সাদা ফ্ল্যাগ উড়িয়ে জীপটা যখন ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়ার্টারে প্রবেশ করলো, বাইরে ডিউটিরত পাকিস্তানী সৈন্যরা অবাক বিস্ময়ে ভারতীয় জীপটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ঘড়িতে সকাল নয়টা। হেডকোয়ার্টারে বসে আছেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে পরিচিত টাইগার জেনারেল নিয়াজী, মেজর জেনারেল জামসেদ, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং নৌবাহিনী প্রধান রিয়াল এ্যাডমিরাল শরিফ। দু’জন অফিসার জেনারেল নিয়াজীকে সামরিক কায়দায় স্যালুট দিয়ে চিঠি তার হাতে দিলেন। চিঠি পড়ে জেনারেল নিয়াজীর মুখ মুহূর্তেই ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল। চিঠিটা সেখানে উপস্থিত সকলে পড়ে সলাপরামর্র্শ করে ঠিক করলেন যে মিত্রবাহিনী যখন আমাদের একেবারেই দ্বারপ্রান্তে এবং এদের প্রতিরোধ করার মতো আমাদের যথেষ্ট রিজার্ভ বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র নেই, তখন নাগরা যা বলছে তাই করাই শ্রেয়। (উইটনেস টু সারেণ্ডার, সিদ্দিক সালেক) ইতিহাসবিদদের মতে, ১৬ ডিসেম্বর সকালে মেজর জেনারেল নাগরার এক চিঠিতেই লৌহ সমতুল্য পাকিস্তান প্রতিরক্ষা ব্যুহ এক নিমিষেই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়লো। সকলে মিলে ঠিক করলেন মিরপুর ব্রিজের কাছে অবস্থানরত মেজর জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানাতে মেজর জেনারেল জামসেদ যাবেন। সঙ্গে সঙ্গে মিরপুর ব্রিজের কিছু দূরে পাকিস্তানী ক্যাম্পে জরুরী ম্যাসেজ পাঠানো হলো যে, বর্তমানে যুদ্ধবিরতির কথাবার্তা চলছে। তাই মেজর জেনারেল নাগরার ঢাকা নগরীতে প্রবেশের সময় যেন কোন বাধা না দেয়া হয়। এদিকে মেজর জেনারেল নাগরা খুবই উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করছেন কখন এবং কি খবর নিয়ে সাদা ফ্ল্যাগওয়ালা জীপটি ফেরত আসবে? প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ব্রিজের ওপর দিয়ে কাক্সিক্ষত জীপটি দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। এই জীপটির পেছনে আরও একটি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাদা ফ্ল্যাগওয়ালা জীপ দেখা গেল। জীপের সামনে এক মেজর গম্ভীরভাবে বসে আছেন। জীপটি তাঁদের সামনে থামতেই মেজর লাফ দিয়ে নেমেই মেজর জেনারেল নাগরা, বাঘা কাদের সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ও সন্তু সিংকে সামরিক কায়দায় স্যালুট দিয়ে বলল, লে. জেনারেলের পক্ষ থেকে আপনাদের অভ্যর্থনা জানাতে ব্রিজের অপর পাড়ে মেজর জেনারেল জামসেদ অপেক্ষা করছেন। এই বলে লে. জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের বার্তা সম্বলিত চিঠিটি মেজর জেনারেল নাগরার হাতে দিলেন। সমর্পণের বার্তাটি পেয়ে ততক্ষণে তারা জীপে উঠে ব্রিজের ওপারে গেলেন। মেজর জেনারেল জামসেদ তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজের স্টাফ গাড়িতে বসার অনুরোধ জানালেন। স্টাফ গাড়িটি যখন ৩৬ ইনফ্যানট্রি ডিভিশন হেড কোয়ার্টারে প্রবেশ করলো তখন ঘড়িতে সকাল দশটা দশ বাজে। অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে লে. জেনারেল নিয়াজীর পক্ষ থেকে তাঁদের স্বাগত জানালেন পাকিস্তান আর্মির চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বারেক। তিনি তাঁদের অফিসের ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র লে. জেনারেল নিয়াজী চেয়ার থেকে ত্বরিত গতিতে উঠে মেজর জেনারেল নাগরার সঙ্গে করমর্দনের জন্য এগিয়ে এলেন। এই সময়ে অফিসের ভেতর অন্য চেয়ারে যারা ছিলেন তাঁরা হলেনÑ মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর উর্ধতন কিছু কর্মকর্তা। করমর্দনের পর সেখানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হলো। দেখা গেল লে. জেনারেল নিয়াজী মেজর জেনারেলের কাঁধে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মেজর জেনারেল নাগরা তার পিঠে যতই হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দিচ্ছেন, ততই তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছেন, আর অকথ্য ভাষায় পিণ্ডির হেডকোয়ার্টারকে গালিগালাজ করছেন। বলছেন, ওইসব বেজন্মাদের জন্য আজ আমার এই করুণ দশা। জেনারেল নিয়াজীর কান্না থামিয়ে একটু ঠাণ্ডা হতেই মেজর জেনারেল নাগরা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করলেন। প্রথমেই কাদেরীয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয়। বললেন, এই সেই কাদেরীয়া বাহিনী প্রধান বাঘা সিদ্দিকী। যার মাথার মূল্য আপনি ধরে দিয়েছেন দশ লাখ টাকা। কাদের সিদ্দিকীর পরিচয় জেনেই জেনারেল নিয়াজী প্রথমেই চম্কে উঠলেন। তারপর সামরিক কায়দায় এ্যাটেনশন হয়ে খটাস করে তাঁকে স্যালুট দিয়ে করমর্দনের জন্য তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। কাদের সিদ্দিকী ঘৃণাভরে বলে উঠলেন, যার হাতে ত্রিশ লাখ শহীদের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে সেই হাতের সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী করমর্দন করে না। পাশে দণ্ডায়মান মেজর জেনারেল নাগরা বলে উঠলেন, কি করছেন আপনি? আপনার সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাহিনীর পরাজিত সেনাপ্রধান। ওনার সঙ্গে করমর্দন করা বিজিয়ীদের পক্ষে গৌরবের কথা। এই কথা শুনে বাঘা সিদ্দিকী অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়াজীর সঙ্গে করমর্দন করলেন। (আমি বিজয় দেখেছি, এম আর আক্তার মুকুল)। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর ওখানে বসেই আত্মসমর্পণের সময়, স্থানসহ অন্যান্য কর্মপন্থা তাদের সঙ্গে এবং ওয়্যারলেসের মাধ্যমে কলকাতায় অবস্থিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে স্থির করা হলো। আজ ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ বিকেল সাড়ে ৪টার মধ্যে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ভাষণ দিয়েছিলেন, ঠিক সেই স্থানে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর দান করা হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রী দিল্লী সরকারের সঙ্গে আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত কাগজপত্র ও দলিল সম্পর্কে আলোচনাকালে জানতে পারলেন আত্মসমর্পণের কাগজপত্র ও দলিল তৈরি করা হয়েছে, ইতোমধ্যে তা লোক মারফত প্লেনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বেলা প্রায় ১টার সময় ভারতীয় একটি হেলিকপ্টারে করে মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের কাগজপত্র ও দলিল নিয়ে ঢাকায় পৌঁছেই ইস্টার্ন কমান্ডের অফিসে গিয়ে আলোচনারত পাকিস্তানী উর্ধতন কর্মকর্তাদের হাতে দলিল ও কাগজপত্রগুলো দেখার জন্য দিলেন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী একনজর দলিল দেখেই আপত্তি উত্থাপন করলেন- বললেন, “বাংলাদেশ ভারত জয়েন্ট কমান্ডারের কাছে” কথাটা থাকতে পারে না। আমরা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করব। মেজর জেনারেল জ্যাকব বললেন, এ দলিল দিল্লী থেকে তৈরি হয়ে এসেছে। এর কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংশোধন করার ক্ষমতা আমাদের নেই। জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলটা নিয়ে পুঙ্খানুুপুঙ্খভাবে দেখে এই দলিলেই স্বাক্ষর দিতে সম্মত হলেন। বিকেল সোয়া চারটার দিকে অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পরাজিত অধিনায়ক লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীসহ অন্য উপস্থিত দুই পক্ষের সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আত্মসমর্পণ মঞ্চে উপস্থিত হলেন। মনে হলো যেন সমগ্র বিশ্ব কয়েক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে থমকে দাঁড়ালো। তারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলো পৃথিবীর বুকে এক নব ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। চারদিকে তখন দশ লাখ জনতার বিজয় উল্লাসের হর্ষধ্বনি আর ময়দানে উপস্থিত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে আকাশের দিকে অবিরাম গোলাবর্ষণ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৬ তারিখে বিকেল ৪টার বেজে ২১ মিনিটে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক বাহিনীর পরাজিত অধিনায়ক লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলে কাঁপা কাঁপা হাতে স্বাক্ষর করলেন। এই স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো পূর্ব পাকিস্তানের ২৩ বছরের কলঙ্কিত ধূসর সূর্যটা আস্তে আস্তে পশ্চিমাকাশে চিরজীবনের জন্য অস্তমিত হয়ে গেল। স্বাক্ষর গ্রহণের পর পাকিস্তানের অধিনায়ক লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী কোমর থেকে সুদৃশ্য রিভলবার ও বেল্ট এবং কাঁধ থেকে র‌্যাঙ্কিয়ের সব ব্যাজ খুলে জগজিৎ সিং অরোরার হাতে দিলেন। এরপর মাঠে উপস্থিত পাকিস্তানের উর্ধতন কর্মকর্তারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কোমর থেকে অস্ত্র ও বেল্ট, কাঁধ থেকে র‌্যাঙ্কিয়ের ব্যাজ খুলে সামনে মাটিতে রেখে দিল। সামনে বিজয় উল্লাস দশ লাখ জনতা ও শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও পর্যটক এই অভূতপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করলেন। লেখক : সাংবাদিক, গবেষক
×