ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোকেয়া পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

নিরক্ষর থাকবে না কোন মেয়ে, আমরা এগিয়ে যাব ॥ শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

নিরক্ষর থাকবে না কোন মেয়ে, আমরা এগিয়ে যাব ॥ শেখ হাসিনা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কোন মেয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে না- এ ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে থাকবে না বলে ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করে বলেন, ‘তিনি অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন বলেই আমরা এই জায়গায় আসতে পেরেছি। তিনি যদি না থাকতেন, আমাদের শিক্ষার পথ না দেখালে-আমরা এতদূর এগিয়ে যেতে পারতাম না।’ মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে চলতি বছরের রোকেয়া পদক অধ্যাপক মমতাজ বেগম ও গোলাপ বানুর হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। নারী শিক্ষা বিস্তার, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী উন্নয়নসহ অসহায় ও দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এই দুই নারীকে এ বছর ‘রোকেয়া পদক’ দেয়া হয়েছে। পদকপ্রাপ্তদের একটি করে স্বর্ণপদক, সনদ আর এক লাখ টাকার চেক দেয়া হয়েছে। ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০১৪’ বিতরণ ও বেগম রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোন মেয়ে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ বাংলাদেশে পাবে না- সে রকম থাকবে না। কোন মেয়ে নিরক্ষর থাকবে না। কারও দিকে তাকাতে হবে না। আমরা নিজেরাই এগিয়ে যাব।’ মেয়েদের সমান সুযোগ করে দিতে না পারলে সমাজের উন্নয়ন হবে না বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই অঞ্চলে মুসলিম পরিবারের মেয়েদের অবস্থার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সে সমাজে মেয়েদের নিচু চোখে দেখা হতো। আমাদের মুসলিম মেয়েদের অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। সেখানে বেগম রোকেয়া বিপ্লব করেছেন।’ নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সমাজের নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকা একান্ত প্রয়োজন। সমাজের অর্ধেক শিক্ষিত না হলে, সমাজ এগোবে না।’ বেগম রোকেয়া তাঁর মতিচুর গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘আমরা সমাজেরই অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে-একই। তাঁহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, প্রত্যেকটা নারী সমান সুযোগ পাবে,’ রোকেয়ার এই লাইনগুলো উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি নারীস্থানের স্বপ্ন দেখতেন। আমরা তার নারীস্থানের স্বপ্ন অনেকাংশে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পীকারের পাশাপাশি বিচারপতি থেকে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং সশস্ত্র বাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণের কথাও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। অবহেলিত নারী সমাজকে অশিক্ষার অভিশাপ হতে মুক্ত করতে বেগম রোকেয়ার ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওনার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি মেয়েদের শিক্ষার কথা বলতেন।’ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে সচিব তারিক-উল-ইসলাম স্বাগত বক্তব্য দেন। রোকেয়া পদক গ্রহণ করে রোকেয়ার অমর বাণী উদ্ধৃত করে মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম বললেন, বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদের যা করিতে হয় তাহাই করিব। প্রয়োজন হলে আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি জজ সবই হইব। পঞ্চাশ বছর পর ভাইসরয় হয়ে এদেশের সমস্ত নারীকে ‘রাণী’ করিয়া ফেলিব।’ মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম আরও বলেন, ‘আমরা এখন রাণী হয়েছি। নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী স্পীকার, এখন আমরা রাণী।’ মমতাজ বেগম তার নিজের মা এবং বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিবের উদ্দেশে রোকেয়া পদক উৎসর্গ করেন। ১৯৭২ সালের নারী পুনর্বাসন বোর্ডের সদস্য হিসেবে মমতাজ বেগম সারাদেশে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই নারী ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদেরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগমের জন্ম নেন ১৯৪৬ সালের ১৩ এপ্রিল কুমিল্লায়। ১৯৬২ সালের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ১১ দফাসহ বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মমতাজ বেগম শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। এর আগে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, নারী প্রগতি সংঘ, জাসদ, নৌ কমান্ডো ও নারী ফাউন্ডেশনের সম্মাননাও তিনি পেয়েছেন। রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত আরেকজন গোলাপ বানু। ১৯৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় জন্ম নেয়া গোলাপ বানুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সমবায় সমিতির মাধ্যমে তিনি নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। কয়েকজন নারীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৬ সালে গোলাপ বানু বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি চালু করেন, যে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা এখন ৩৬ হাজার ৬৭৩ জন। সমবায়ের মাধ্যমে এ সমিতি গত ১৮ বছরে ১৪৪ কোটি টাকার পুঁজি গড়ে তুলেছে। গোলাপ বানুর উদ্যোগে এ সমিতির সদস্যদের শিক্ষায় বর্তমানে ছয়টি স্কুলও পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া অসহায় ও দুস্থ নারীদের ধাত্রী সেবা দেয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছেন তিনি। বাঙালী নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মৃতিতে ১৯৯৫ সাল থেকে এই পদক প্রবর্তন করে বাংলাদেশ সরকার। প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এই পদক বিতরণ করা হয়। রোকেয়া দিবস পালন করেছে বিপ্লবী নারী সংহতি। এ উপলক্ষে সংগঠনের পক্ষ থেকে সকাল ৮-৩০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের রোকেয়া ভাস্কর্যের বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শেষে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক শ্যামলী শীলের নেতৃত্বে বক্তব্য রাখেন সহ-সমন্বয়ক তাসলিমা আখ্তার, সদস্য রেবেকা নীলা, অপরাজিতা দেব, জান্নাতুল মরিয়ম এবং সংহতি বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহসভাপতি তাহমিদা ইসলাম তানিয়া, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি বহ্নি প্রমুখ। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য নাসরিন আকতার সুমি। সমাবেশে বক্তারা সারাদেশে অব্যাহতভাবে চলা নারী নিপীড়ন-ধর্ষণ-সহিংসতা এবং প্রশাসনসহ সকল পর্যায়ে নারী বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে নিন্দা ও ধিক্কার জানান। এ সকল নিপীড়ন-বৈষম্য-সহিংসতা প্রতিরোধে নারীদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান তারা। বক্তারা বলেন, শতবছর আগে রোকেয়া উপনিবেশবিরোধী জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের প্রধানশক্তি হিসেবে নারীদের সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আজও জাতীয় আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় হওয়া ছাড়া বর্তমান দুঃসহ পরিস্থিতি হতে আমাদের মুক্তি সম্ভব নয়। নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, রোকেয়ার সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় নারীরা আত্মমর্যাদা ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। সমাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে নারীদের অপরিহার্য অবদান সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক আইনে, মজুরি প্রশ্নে নারী-পুরুষের সমতা অর্জিত হয়নি। নারীসহ অধিকাংশ নিপীড়িত মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করেন নেতৃবৃন্দ। ‘দেশ-জাতি-সমাজের কল্যাণে রোকেয়া একটি পবিত্র নাম’ ॥ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রাসঙ্গিকতা চিরকালীন। দেশ-জাতি-সমাজের সর্বতোমুখী কল্যাণে রোকেয়া একটি পবিত্র নাম হিসেবে যুগে যুগে উচ্চারিত হবেন। তাই জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিতের মাধ্যমে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই রোকেয়াকে স্মরণ করা সার্থক হবে। রোকেয়া দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একক বক্তৃতানুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। মঙ্গলবার বিকেলে বাংলা একাডেমির আয়োজনে একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে রোকেয়া দিবস উপলক্ষে একক বক্তৃতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোঃ আলতাফ হোসেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ও নারী আন্দোলন শীর্ষক বক্তৃতা করেন বিশিষ্ট গবেষক, অধ্যাপক মালেকা বেগম। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস এনডিসি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. পারভীন হাসান, মানবাধিকার নেত্রী ড. হামিদা হোসেন, জাতীয় সংসদ সদস্য কবি কাজী রোজী, লেখক-গবেষক নিলুফার বেগম প্রমুখ। অধ্যাপক মালেকা বেগম বলেন, যে সময় ও পরিবেশে শুধু মুসলিম নয়, হিন্দু সমাজেও পর্দা-অবরোধের চাপ এবং শিক্ষা-নিষেধাজ্ঞায় মেয়েদের জীবন পরমুখাপেক্ষী, পরনির্ভর, নির্যাতিত, বঞ্চিত, বৈষম্যপীড়িত ছিল সেসময় আলোকবর্তিকা হিসেবে উঠে এসেছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। নারীবাদী লেখক এবং প্রায়োগিকভাবে নারীমুক্তির অগ্রবর্তী সংগঠক হিসেবে রোকেয়ার তুলনারহিত অবদান আজ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। রোকেয়ার প্রদর্শিত পথ ধরে আমাদের নারী আন্দোলন পেয়েছে নতুন দিশা ও মাত্রা। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নারীর অসাধারণ অবদান মূলত শিক্ষা ও সচেতনতার বিস্তারেরই লক্ষণ। একক বক্তা বলেন, বাংলাদেশের নারী আন্দোলন আজ এক নতুন মাত্রায় উন্নীত। এখন আমরা ফতোয়াবিরোধী আইনী কার্যক্রম, নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং সামগ্রিকভাবে নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ; তাই এখনও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের যুগের পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্যে আমাদের ঘুরপাক খাওয়া হতাশাজনক। অবিলম্বে এ থেকে উত্তরণ এবং গুণগত পরিবর্তনের শুভসূচনা করতে হবে। মোঃ আলতাফ হোসেন বলেন, রোকেয়ার নারীমুক্তি চেতনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক নানান ক্ষেত্রে নারীরা অসামান্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। তবে আজও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নানা ক্ষেত্রে নারীসমাজ বৈষম্য ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন যার অবসানে নারী-পুরুষ সবাইকে মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
×