ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি এখনও মুখ থুবড়েই পড়ে আছে

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি এখনও মুখ থুবড়েই পড়ে আছে

মানিক সরকার মানিক, রংপুর থেকে ॥ অন্ধকার থেকে আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া মহীয়সী রোকেয়ার পায়রাবন্দ এখন আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত। শুধুমাত্র সরকারী সদিচ্ছা আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ’ হিসেবে গড়ে তোলা ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’টি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত এ কেন্দ্রটি বিগত জোট সরকারের সময় থেকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আজ। ইতোমধ্যেই কেন্দ্রের অবকাঠামো আসবাবপত্র অত্যাধুনিক অডিটোরিয়ামসহ মূল্যবান মালামাল অযতœ অবহেলায় আজ বিলীন হওয়ার পথে। পোকায় খেয়ে শেষ করছে লাইব্রেরির মূল্যবান বইপত্র। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রায় এক যুগ ধরে বিনা বেতনেই আগলে রেখেছেন এর যাবতীয় অবকাঠামো। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষেরও যেন নেই কোন মাথা ব্যথা। সমাজ পরিবর্তনে পুরুষের রক্তচক্ষু শাসিত শত বাঁধা-বিঘœ পেরিয়ে যে মহীয়সী নারী রংপুরের এই অজপাড়াগাঁ-পায়রাবন্দ থেকে জ্বালিয়েছিলেন নারী শিক্ষার আলো, যে পায়রাবন্দ থেকে সমাজের যত অনাচার কুসংস্কার দূর করে জগতখ্যাত হয়েছিলেন তিনি, তাঁর সে স্বপ্ন-স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে যেখানে গড়ে উঠেছিল এ কেন্দ্রটি, তার এ বেহাল দশায় উদ্বিগ্ন পুরো দেশবাসী। অবিলম্বে তারা এ স্মৃতি কেন্দ্রকে রাহুমুক্ত করে এর কার্যক্রম চালুর দাবি তুলেছে। রোকেয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে পায়রাবন্দে স্মৃতি কেন্দ্র স্থাপন, তার নামে একটি মহিলা ক্যাডেট কলেজ স্থাপনসহ নানা দাবি ছিল এ অঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের। ’৯৬ সালে তৎকালীন সরকার রোকেয়ার জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তাঁর আদর্শে নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই ‘রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। স্মৃতি কেন্দ্রে গড়ে তোলা হয় সেমিনার কক্ষ, ২৫০ আসনের মিলনায়তন, আর্কাইভ, গবেষণা কেন্দ্র, নামাজ ঘর, রোকেয়া ও তাঁর উত্তরসুরীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের একটি জাদুঘর, সংগ্রহশালা, দেশী বিদেশী পর্যটকদের জন্য অতিথিশালা, কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য কোয়ার্টার, ভাস্কর্য এবং আকর্ষণীয় একটি তোরণ। এখান থেকে রোকেয়ার ওপর ফেলোশীপ প্রদানেরও ব্যবস্থা ছিল। ২০০১ সালের ১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন এবং কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এ কেন্দ্রটিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার উদ্যোগ নেয়। সে থেকেই এর কার্যক্রমে নেমে আসে স্থবিরতা। একে একে তুলে নেয়া হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ লোকবল। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিং ইম্পোটার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) আয়োজনে এ কেন্দ্রে চালু করা হয় গার্মেন্টস প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের। তখন প্রশ্ন ওঠে, শুধুমাত্র গার্মেন্টস প্রশিক্ষণ দিয়েই কী রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন আর স্মৃতি কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্য সফল হবে? যে কারণে কেউই শিক্ষা সংস্কৃতির পাদপীঠ রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রে গার্মেন্টস প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে ভালভাবে মেনে নেয়নি। বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ এবং বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ যৌথভাবে এই গার্মেন্টস প্রশিক্ষণের বৈধতা নিয়ে এবং কেন তা স্থগিত করা হবে না জানতে চেয়ে হাইকোর্টে রীট করলে হাইকোর্ট তা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। সেই থেকে বন্ধ হয়ে যায় প্রশিক্ষণ। তিনি জানান, রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র হবে শুধুমাত্র শিক্ষা সংস্কৃতি ও নারী তীর্থ কেন্দ্র। রোকেয়ার উত্তরসুরী বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মেয়ে শিক্ষিকা রঞ্জিনা সাবের চৌধুরী জানালেন, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে স্মৃতি কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা তার কী বাস্তবায়ন হবে না? কেন স্মৃতি কেন্দ্রের কার্যক্রম চালু হচ্ছে না এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল ফারুক জানান, এটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিষয়। তিনি জানান, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এই কেন্দ্রকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার প্রক্রিয়া নেয়া হলে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তিনিসহ ৪ কর্মকর্তা হাইকোর্টে একটি রীট করেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে আদালত স্মৃতি কেন্দ্রটিকে অন্য কোন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত না করার বিষয়ে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। সেই থেকে এর কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। উপ-পরিচালক জানান, খুব শীঘ্রই এ ব্যাপারে শুনানি শেষে চূড়ান্ত আদেশ পাওয়া গেলেই এর কার্যক্রম শুরু হতে পারে। জানা গেছে, ২০০৪ সালের জুন মাস থেকে তিনিসহ এখানকার ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী বিনা বেতনে কাজ করছেন। তারা না পারছেন চাকরি ছেড়ে চলে যেতে, না পারছেন ধরে রাখতে। তিনি জানান, জনপ্রশাসন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও মিঠাপুকুর আসনের সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমান গত ৩ ডিসেম্বর স্মৃতি কেন্দ্রটি চালু এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জন্য সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছেন। স্মৃতিকেন্দ্রকে মন্ত্রণালয়ে নেয়া নিয়ে চলছে টানা হেঁচড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ’ হিসেবে ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’টি গড়ে উঠলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এটিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। রোকেয়ার তথ্য সংগ্রাহক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ কেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নেয়া হবে এ প্রসঙ্গে তৎসময়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সাহেদ তাদের জানিয়েছিলেন, অর্থাভাবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অনেক কাজ করতে পারে না বলেই মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটিকে ন্যস্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে রাজবাড়িতে ‘মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র’ নামে আরও একটি প্রকল্প রয়েছে, সেটিকে তো অন্য কোন মন্ত্রণালয়ে নেয়া হয়নি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনেই তার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও বাংলা একাডেমি থেকে জানান হয়েছে, যেহেতু বেগম রোকেয়া একজন মহিলা, মহিলাদের নিয়ে তিনি কাজ করেছেন কাজেই তাঁর নামে গড়ে ওঠা স্মৃতি কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নেয়া অযৌক্তিক নয়। এ প্রসঙ্গে দুলাল বলেন, একজন লেখক কিংবা মনীষীর কোন জেন্ডার নেই। নারী পুরুষের ভেদাভেদ ও বৈষম্য ভুলে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় যে রোকেয়া সমাজ থেকে দূর করেছেন অনাচার আর কুসংস্কার তিনি নিজেই আজ সেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, মহিলা বলে এবং মহিলাদের নিয়ে কাজ করেছেন বলেই যদি এই স্মৃতি কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যায়, তবেতো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মীর মশাররফ, লালন সাঁই এঁদের জন্যও পুরুষবিষয়ক মন্ত্রণালয় খোলা দরকার।
×