ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আগেই অধিগ্রহণ

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৪

আগেই অধিগ্রহণ

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি সঙ্কট কাটানোর বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়নে ভূমি সঙ্কট পিছু ছাড়ছে না বরং দিনে দিনে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন হোঁচট খাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা হচ্ছে। এ নিয়ে আগামী বুধবার বৈঠক ডেকেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সূত্র জানায়, প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে প্রকল্প অনুমোদনের আগেই জমি অধিগ্রহণ নিশ্চিত করার বিধান তৈরি করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রীর সচিব আবুল কালাম আজাদ। বৈঠক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এবি মির্জা মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। করতে পারলে ভাল হয়। আমি যখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তখনই বলেছিলাম কোন প্রকল্প গ্রহণের আগেই যেখানে অবকাঠামো হবে সেখানকার ভিডিও ধারণ করে রাখতে হবে। কেননা মানুষজন যদি শোনে কোন অবকাঠামো হতে তাহলে ঘরবাড়ি তৈরি করে রাখে। পরবর্তীতে উচ্ছেদ করতে গেলে মামলা-মোকদ্দমা হয়। সরকার ইচ্ছে করলেই কোন প্রকল্পের জন্য ল্যান্ড রিকিউজিশন আইনের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণ করতে পারে কিন্তু তার দখল পেতে দেখা যায় নানা সমস্যা। এসব ঝামেলা এড়াতে সরকারের এ উদ্যাগটি ভাল ভূমিকা রাখবে। সূত্র জানায়, এর আগে পদ্মা বহুমুখী সেতু বাস্তবায়ন বিলম্ব হওয়ার কিছু কারণ তুলে ধরেছিল বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এর মধ্যে অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে প্রথমেই তুলে ধরা হয়েছিল ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব হওয়ার কারণে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন দেরি হয়। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প দেরি হওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে জমি নিয়ে সমস্যা। কেননা প্রকল্পের মধ্যেই কবরস্থান ও মসজিদসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থাপনা পড়েছিল। সেগুলো সরাতে গিয়েই নানা ঝামেলা দেখা দেয়। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, জমি সমস্যার কারণেই অনেক উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প। অনেক সময় দেখা যায় জমি নিয়ে মামলা হয়, ফলে সে প্রকল্পের কাজ আর এগুতে পারে না। প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হলে ব্যয় বেড়ে যায়। সরকারকে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়। তাছাড়া প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যও ব্যাহত হয়। সেক্ষেত্রে সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সূত্র জানায়, ২০১১-১২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর দুই মাসের অগ্রগতি সংক্রান্ত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৪১৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ৩৮৮ কোটি ৭১ লাখ এবং বৈদেশিক সাহায্য থেকে ২৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। মোট বরাদ্দের মধ্যে ওই অর্থবছরে আগস্ট পর্যন্ত মন্ত্রণালয় ব্যয় করতে পেরেছিল মাত্র ১৬ কোটি ২ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের তিন দশমিক ৮৪ শতাংশ। এত কম টাকা ব্যয় করার কারণ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, প্রধান সমস্যাই হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যা। আইন ও বিচার বিভাগের ছয়টি প্রকল্পের বিপরীতে ওই অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ১৩৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ১৩৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৮০ লাখ টাকা। আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩৭ লাখ টাকা। এডিপি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মূল সমস্যা দেখা দিয়েছে জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় অনুমোদিত মূল্যে জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৩৩টি প্রকল্পের বিপরীতে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৪৭৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ৩৭৭ কোটি ৯৯ লাখ এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৯৮ কোট ২৬ লাখ টাকা। আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে ৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১২ শতাংশ। এই মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখানে হয়েছে জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৪টি প্রকল্পের বিপরীতে এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ২৬২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ২৪৩ কোটি ৯৪ লাখ এবং বৈদেশিক সহায়তার ১৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরের দুই মাসে ব্যয় করা হয়েছিল মাত্র দুই কোটি ৫৭ লাখ ১০ হাজার টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এ মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের সমস্যা হিসেবে বলা হয়েছে ভূমি সমস্যা। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের দুটি প্রকল্পের বিপরীতে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২৪১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ১৬৫ কোটি ৩৮ লাখ এবং বৈদেশিক সাহায্যের ৭৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছিল নয় কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের তিন দশমিক ৭২ শতাংশ। নির্বাচন কমিশনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যার মধ্যে অন্যতম বলা হয়েছে সিএসএসইডি প্রকল্পের আওতায় জেলা বা আঞ্চলিক সার্ভার স্টেশন ভবন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের চারটি প্রকল্পের বিপরীতে এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ১৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ১৩৮ কোটি ৫২ লাখ এবং বৈদেশিক সহায়তার তিন কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৮ কোটি ২২ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এই মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাই ছিল জমি অধিগ্রহণ বা হস্তান্তর। প্রকল্পের ভূমি সংক্রান্ত নতুন সিদ্ধান্তের বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এর সুবিধাও যেমন আছে তেমনি ঝুঁকিও রয়েছে। কেননা প্রকল্প অনুমোদনের আগেই যদি ভূমি অধিগ্রহণ করা হয় তাহলে ওই প্রকল্প নিশ্চিত অনুমোদন দিতে হবে। তখন অনুমোদন না দিলে তারা বলবে তাহলে জমি অধিগ্রহণ করলেন কেন? এ রকম নানা ঝুঁকি থেকে যায়।
×