ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি কোন্ পথে যাবে

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

বিএনপি কোন্ পথে যাবে

ঘরে শুয়ে-বসে থেকে মাঝে মাঝে গলা উঁচিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে ক্লান্তপ্রায় বিএনপি। কিন্তু এই ক্লান্তি বুঝি ক্ষমাহীন। তাই শক্তিহীন ও অকর্মণ্য দলে পরিণত বিএনপিকে বেছে নিতে হয়েছে চোরাগুপ্তা পথ। কঠোর আন্দোলন, সরকারকে এক ধাক্কায় নামিয়ে ফেলার মতো আস্ফালন যে স্রেফ অক্ষমের আর্তনাদ; তা জনমনে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত। ঘোষণাও ছিল, ঈদের পর দেশব্যাপী সরকার পতনের আন্দোলনে নেমে পড়বে। দুই ঈদ পেরিয়ে গেছে কবে, বিজয় দিবসও পার হয়, পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় কত জল এলো গেলো, কত স্্েরাত বয়ে যায়। গড়িয়ে যায় কত ইস্যু অথচ আন্দোলনের আর নামগন্ধ নেই। ক্ষমতাসীন সরকারের বিগত আমলেও তারা ‘এই ফেলে দিচ্ছি, এই ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে সরকার’ জাতীয় চিৎকার-চেঁচামেচি কম করেনি। কিন্তু ছোটখাটো বিক্ষোভ কর্মসূচী ছাড়া আর কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। বুঝি হম্বিতম্বিই সার। বড় ধরনের আন্দোলন দূরে থাক, সামান্য একটি মিছিলও করতে পারছে না। দুর্বলতার ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছে প্রায় বিএনপির আন্দোলন সংঘটিত করার ক্ষমতা খর্ব হতে হতে শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে বলা যায়। নেতারা রিপভ্যান উইংকেলের মতো টানা ঘুমে কাটিয়ে দিচ্ছে। জেগে থাকা দু’একজন মাঝে মাঝে গহ্বর থেকে মাথা তুলে গলা বাড়িয়ে গীত গায় সরকারের পতন ঘটানোর। দিবাস্বপ্ন তাদের এতই প্রগাঢ় যে, স্বপ্নে বিরিয়ানি-পোলাও খাওয়ার মতো মসনদে আসীন হয়ে একচ্ছত্র ছড়ি ঘুরাচ্ছে। এমনিতেই বিএনপির আন্দোলন ক্ষমতা সম্পর্কে অনেকের মূল্যায়ন খুব ইতিবাচক নয়। খোদ বিএনপি নামক দলের কোন স্তরের নেতাকর্মীই দলের প্রতি এবং দলীয় কর্মকা-ের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে, তা নয়। মঞ্চের শোভা হতেন যেসব প্রবীণ নেতা দুরবিনে খুঁজে পেতে হয় তাদের এখন। বর্তমান অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে বিএনপি-জামায়াত দলের রাজনীতিতে নেই কোন অভিনবত্ব বা বৃত্তবন্দী রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার সহসী উদ্যোগ। শীর্ষ নেতৃত্ব ভুগছে প্রতিহিংসার এক প্রকার দুরারোগ্য বিকারে। ২০ দলীয় জোটের প্রধান দলটির প্রতিহিংসার রাজনৈতিক বৃত্তের ঘোরাফেরা প্রশমিত হওয়ার পরিবর্তে মাঝে মধ্যেই জিঘাংসার পর্যায়ে পেঁৗঁছে যায়। তাই ২০১৩ সালে যে বিএনপি জঙ্গী, জামায়াত, হেফাজতকে নিয়ে সহিংসতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছিল তা স্তিমিত হয়ে এলেও, সেই পর্যায় হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই হুঙ্কার দিয়ে, গর্জন তোলে বন কাঁপিয়ে তুলতে চায়। কিন্তু বনের গাছপালার পাতাও তাতে কম্পন তোলে না। একটি চলমান আন্দোলনের গতি, প্রকৃতি এবং কৌশল রাজনীতির অনেক উপাদান নির্ণয় করে থাকে। কিন্তু বিএনপি যে আন্দোলন করতে চায় তার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা না থাকায় শুরুতেই হোঁচট খায়। আন্দোলনের মেজাজ ধরে রাখতে নেতারা অনেক অগোছালো, অসংলগ্ন কথাবার্তা বললেও তাতে কোন ফলোদয় হয়নি। বিএনপির আন্দোলন নামক অধরা বিষয়টির আদতে কোন ইস্যু নেই। অবশ্য সরকারী দলের কর্মকা-ে প্রদত্ত ইস্যুর আধিক্য বিএনপির জন্য সবচেয়ে মারাত্মক বা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বাছাই দুরূহ হয়ে পড়ছে। শুধু দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা ও অবক্ষয়ের বিষয়টিই যদি ধরা যায়, এর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে বছরের পর বছর আন্দোলন চলতে পারে। যুগ যুগ ধরে যে কোন গণতান্ত্রিক দেশের জনসম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে আন্দোলন দেশবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে বিবেচ্য। কিন্তু বিএনপি সেই অধিকারের পথে সামান্যও অগ্রসর হয়নি। জনজীবনের কোন সমস্যাই তাদের দৃশ্যগ্রাহ্য হয়নি। বরং দুর্নীতিগ্রস্ত দলীয় নেতাসহ দলকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে তাদের হাঁকডাক এবং উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়। বিএনপির কাছে আন্দোলন মানেই রাজপথভিত্তিক উত্তাপ সৃষ্টি এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হওয়া। যাত্রীসহ যানবাহন পোড়ানোর মতো নিন্দিত-গর্হিত কাজ থেকে বিএনপি সরে আসেনি বরং এসব কাজে জামায়াতকে সহায়তা, সহযোগিতা করে আসছে। বিএনপি গত ৬ বছরের বেশি সময় ধরে মূলত জামায়াতের রাজনৈতিক এজেন্ডা কার্যকর করার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিল। যুদ্ধাপরাধী রক্ষার অসদুদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল। জামায়াতের সহিংস কর্মকা-কে স্বীকৃতি শুধু নয়, তাতে সহায়কশক্তি হিসেবে এগিয়ে এসেছিল। মানুষ হত্যা, যাত্রীসহ যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, বৃক্ষ কর্তনসহ নাশকতামূলক কাজে বিএনপি যে অবস্থান নিয়েছিল, তা ধোপে টেকেনি বরং এসব কর্মকা- বিএনপিকে জনগণের কাছ থেকে দূরত্ব-দূরে সরিয়ে দিয়েছে। রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নামক ‘শ্বেতহস্তী’ নামানো সুদূরপরাহত। গত ৪ বছরের বেশি সময় ধরে এই সরকার ব্যবস্থার স্বপ্ন দর্শনে কেটে গেছে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করার কোন পথ বা দিকচিহ্নও নেই। গত বছর হেফাজত ও জামায়াতকে কাঁধে চড়িয়ে যে নাশকতামূলক রাজনীতিতে বিএনপি নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে, জনগণের ঘৃণা কুড়িয়েছে; সেই দলটির পক্ষে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করা অতি দুষ্কর। কারণ, সে পথ তারা হারিয়ে ফেলেছে। পথহারা পাখির মতো তাই একা একা কেঁদে ফিরে আর বসে বসে হুঙ্কার তোলে, সরকারকে পতনের ঢালে ফেলে দেয়ার। কিন্তু আজ তা বাস্তবতা বিবর্জিত । কারণ, জনগণের রায় নেয়ার পথে তারা যায়নি। নির্বাচনের ট্রেন ‘ফেল’ করার পর থেকেই প্লাটফর্মে বসে থাকতে হচ্ছে। পরবর্তী ট্রেন আসার সময় আরও দূরবর্তী; অন্তত আরও ৪ বছরের ফ্যাঁকড়া। এই সময় পর্যন্ত অপেক্ষার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনÑপরবর্তী সরকার নিয়ে জনগণের কোন ক্ষোভ, শঙ্কা বা বিরোধ নেই; বরং জনগণ শান্তি, স্বস্তিতে রয়েছে। আর এই সময় জনজীবনের দাবি নিয়ে আন্দোলন বা জনমত গড়ে তোলারও অবকাশ পায়নি। দেশের মানুষের আয় বেড়েছে। অতীব দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। তাই দেশজুড়ে জনদাবি বলেও কিছু নেই আজ আর। সুতরাং, সরকারকে হটানো সহজ নয়, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেও। এমনিতে জনগণের কাছে বিএনপির আবেদন ক্রমশ লোপ পেয়েছে। স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথ ছেড়ে বেপথে চলায় দলটি স্বকীয়তা হারিয়েছে। নিজস্ব রাজনীতি ছেড়ে জামায়াত-হেফাজতের ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নে এতই সক্রিয় পন্থা অবলম্বন করে যে, জনগণের কাছে বিএনপি-জামায়াত একই ‘ব্যান্ডে’ পরিণত আজ। বিএনপি ক্ষমতায় আসার জন্য জনগণের ওপর যে নির্ভর করছে তা নয়। জনগণ জানে বিএনপি ক্ষমতায় আসা মানে দুর্র্নীতি, সন্ত্রাস, দলীয়করণ ব্যাধি আবার ছড়িয়ে পড়বে। ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসবে নিপীড়ন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটবে; দেশজুড়ে প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার বন্যা বয়ে যাবে। জনগণের বদ্ধমূল এই ধারণাকে মুছে দেয়ার উপায় বা কৌশল বিএনপির কাছে নেই। এমনিতেই বিএনপির নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত এবং পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এবং তা কখনও মারমুখী। এ অবস্থায় দুর্নীতির মামলায় বেগম জিয়া ও তদীয় পুত্র নির্বাসিত তারেকের বিরুদ্ধে সাজা হলে দলে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এমনকি দলটি কয়েক টুকরোয় বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনেকটা ভাসানী ন্যাপের পরিণতি পাবে। এই ভাসানী ন্যাপই একদিন বিএনপি গড়েছিল। বিএনপির মূল শক্তি ছিল ছাত্রদল। কোন আদর্শ না থাকা সত্ত্বেও এক সময় সংগঠনটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু অছাত্র, ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গড়া ছাত্রদল এখন একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এমনিতেই বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নিয়মিত কাউন্সিল অনুষ্ঠান এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন বালাই না থাকায় দলের ব্যাপকসংখ্যক কর্মী নিষ্প্রভ। অকর্মণ্য দলের চেয়ারপার্সন বিকল্প পথ হিসেবে বিদেশীদের ওপর ভরসা করে আছেন! যদিও প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলগুলোর আস্থা পুনরুদ্ধার করা বিএনপির পক্ষে দূরূহ হয়ে পড়েছে। এটা তো প্রতিষ্ঠিত প্রায় যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে জঙ্গীবাদের প্রত্যাবর্তন ঘটবে, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে আবারও বিভিন্নভাবে মদদ দেবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ ও সাজা মওকুফ করে তাদের অবারও এমপি, মন্ত্রী বানাবে। আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানী চেতনায় কূটনৈতিক তৎপরতা চালাবে। অনেকে এটাও বিশ্বাস করে, বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে হিংস্রতার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। পাকিস্তানী চেতনাকে জাগ্রত করবে। বিদেশীদের প্রতি বিএনপির বিভিন্নমুখী আকর্ষণের কারণ জাতীয় হীনম্মন্যতাই শুধু নয়; দেশকে পাকিস্তানী কায়দায় বিদেশী প্রভু নিয়ন্ত্রক করার পাঁয়তারাও। দেশীয় রাজনীতিতে সরকারী দলকে মোকাবেলা করতে না পেরে দলিলদস্তাবেজ নিয়ে সালিশে নেমেছে। মার্কিন মন্ত্রীদের কাছে জাতীয় আন্তঃকোন্দলকে আন্তর্জাতিক কোন্দলে রূপান্তরিত করার জন্য ধরণাও দিয়েছে। দেশের বিষয়ে বিদেশীদের নাক গলানো মূলত সার্বভৌমত্বের প্রতি এক ধরনের ‘টিটকারি’ বৈকি! দেশবাসীর জন্য যা লজ্জাজনক। গোপনে চূড়ান্ত আন্দোলনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে হঠাৎ একদিন কঠোর আন্দোলনের ডাক দিয়ে রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করে সফলরতা দেখাতে চেয়েছিলেন বেগম জিয়া। কিন্তু সরকারী আমলাদের নিয়ে মধ্যরাতে গোপন বৈঠকের খবর জানাজানি হওয়ায় এ যাত্রায় পরিকল্পনামাফিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে বলে ধারণা করা যায়। বেগম জিয়া তার ডাকে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজপথে নেমে আসবে এমন স্বপ্ন দেখছেন বটে, কিন্তু সে স্বপ্ন স্রেফ স্বপ্নই হয়ে থাকবে। পথ হারাতে হলে পথে নামতেই হয়। কিন্তু বিএনপি তো পথই খুঁজে পাচ্ছে না। পথ তার কণ্টকাকীর্ণ। তা সরিয়ে পুষ্পিত করার স্বপ্ন পূরণ লৌকিকভাবে সম্ভব নয়। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে, নানা দলের-মতের লোকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দল বিএনপি ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসবেÑ এমনটা ভাবার কারণ নেই। চোরাগুপ্তা পথে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। বিএনপির সামনে পথ একটাই খোলা এবং তা হচ্ছেÑজঙ্গী, জামায়াত, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে ষড়যন্ত্রের নানা পন্থা থেকে সরে এসে নেতিবাচক রাজনীতির পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণ ঘটানো।
×