ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিনেতা খলিলের মৃত্যুতে সংস্কৃতিকর্মীদের শোক

প্রকাশিত: ০৫:০০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

অভিনেতা খলিলের মৃত্যুতে  সংস্কৃতিকর্মীদের শোক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের বিশিষ্ট খল অভিনেতা খলিলউল্লাহ খানের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন বিশেষ করে চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষ। বরেণ্য এই অভিনেতা মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। অভিনয় জগতের অনেকেই খলিলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস উইং থেকে ফেসবুক পেইজে তাৎক্ষণিকভাবে শোক জানানো হয়। শোক প্রকাশ করেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং তথ্য সচিব মাহমুদা আক্তার। এদিকে অভিনেতা খলিলের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে চলচ্চিত্র অঙ্গনে। চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক রাজ রাজ্জাক বলেন, কি বলব আমি বুঝতে পারছি না। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারালাম। মজিবুর রহমান মজনুর ‘গু া’ চলচ্চিত্র অভিনয় করতে গিয়ে খলিল সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয়। সেখান থেকেই বন্ধুত্বের শুরু। কিছু দিন আগে ঈদ উপলক্ষে আমার সঙ্গে দেখা করতে বাসায় এসেছিলেন তিনি। তখন অনেক বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। দুজন যখনই এক জায়গায় হতাম, তখনই রাজ্যের গল্প শুরু হতো। বিশেষ করে দুজন যেহেতু একই অঙ্গনের মানুষ, তাই চলচ্চিত্রের ভাল-মন্দ নিয়ে বেশি কথা হতো। শেষবার যখন দেখা হয়েছিল, তখন একসঙ্গে চলচ্চিত্রকে বিদায় জানানোর পরিকল্পনাও করেছিলাম। তা আর হলো না। এছাড়া কিছু দিন আগে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তখন খলিল সাহেবও অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু নিজের শরীরের কথা না ভেবে তিনি আমাকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে এসেছিলেন। এরপর তিনি চলে গেলেন। আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন। খলিলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে স্কয়ার হাসপাতালে যান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। এ সময় আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক ছিল। তাঁর মৃত্যুতে আমার আত্মার একটা অংশ যেন ছিঁড়ে গেল। আমি খুবই মর্মাহত। এখন এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারছি না। অভিনেত্রী ও পরিচালক সুচন্দা বলেন, নায়িকা হওয়ার অনেক আগে থেকে আমি খলিল ভাইয়ের অভিনয় দেখতাম। তিনি একজন প্রাণোচ্ছল মানুষ ছিলেন। কারও মনে কোনো কষ্ট কিংবা তার ওপর রাগ থাকলে তিনি এমন কিছু বলতেন যে না হেসে থাকা যেতো না! খলিল ভাই সামনে এলেই সব দুঃখ ভুলে যেতে হতো। এটা তার অনেক বড় গুণ ছিল। সর্বশেষ তার সঙ্গে আমার এ্যাপোলে হাসপাতালে দেখা হয়েছিল। সেখানে অনেকটা সময় আড্ডা দিয়েছি আমরা। সেদিনের সেই কথাগুলো আজ বারবার কানে বাজছে। আমরা সবাই এখন তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি। এটাই হয়তো নিয়ম। বয়স হলেই চলে যেতে হয়। ববিতা বলেন, খলিল ভাইয়ের মতো শিল্পীদের মৃত্যু নেই। সেই পুতুল খেলার বয়স থেকে খলিল ভাই, গোলাম মুস্তাফা ভাই, শওকত আকবর ভাইয়ের সঙ্গে আমার কাজ করা। তাদের স্নেহেই বেড়ে উঠেছি। নায়কদের চেয়ে তাদের সঙ্গেই আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল। কারণ তাদের সঙ্গে বেশি চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। খলিল ভাই আমার অভিভাবক ছিলেন। সবসময়ই আমার, আমার ছেলে অনিকের খোঁজ খবর রাখতেন। হজ্বে¡ যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল, ফিরে এসেও কথা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে ‘আলোর মিছিল’, ‘বাদী থেকে বেগম’সহ অনেক চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। আমাকে প্রায়ই ‘আপনার জন্য পাত্র দেখছি’ বলে রসিকতা করতেন তিনি। খলিল ভাই সত্যিকারের একজন গুণী শিল্পী ছিলেন। কিন্তু আমরা কী তার মূল্যায়ন করতে পেরেছি? পারিনি। মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি, বিভিন্ন চ্যানেলে শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্য দিয়েই আসলে এই ধরনের গুণী শিল্পীদের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। কবরী বলেন, খলিল ভাইয়ের অভিনয়ে অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে তাঁর গলার আওয়াজটা অনেকখানি সহায়ক হতো। এর ফলে চরিত্রটি হয়ে উঠতো প্রাণবন্ত। অভিনয় করতে গিয়ে কখনও অতিরঞ্জিত কিছু করার চেষ্টা তাঁর মধ্যে দেখিনি। তিনি সাবলীল অভিনয়টাই দেখাতেন। খলিল ভাইয়ের মতো অভিনেতা দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পে অদ্বিতীয়। তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। শবনম বলেন, খলিল ভাই একজন মার্জিত শিল্পী ছিলেন। তার নায়িকা হিসেবে আমিও অভিনয় করেছি। তাঁর মুখে সবসময়ই চেনা হাসি থাকতো। তাঁর মতো এমন গুণী অভিনয়শিল্পী চলচ্চিত্রে খুব কমই দেখেছি। তার শূন্যতা সত্যিই কোনোদিনই পূরণ হওয়ার নয়। অভিনেতা উজ্জ্বল বলেন, নায়ক হওয়ারও আগে খলিল ভাইয়ের অভিনয়ের ভক্ত ছিলাম। সেই পর্দার মানুষটির সঙ্গে যখন একসঙ্গে কাজ শুরু করি তখন পেয়েছিলাম সহযোগিতার হাত। বন্ধুবৎসল একজন মানুষ ছিলেন তিনি। যখন যেখানে থাকতেন তিনি মাতিয়ে রাখতেন তিনি। শুধু তাই নয় জুনিয়র শিল্পীদের আপন করে নেয়ার যে অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাও পরবর্তীতে আমরা কাজ করতে এসে ফলো করেছি খলিল ভাইকেই। একজন অত্যন্ত বিনয়ী, সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষকে হারালাম আমরা। এই ক্ষতি কোনদিনই পূরণ হওয়ার নয়। বলিউড কিং শাকিব খান বলেন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির রূপকারদের মধ্যে খলিল সাহেব ছিলেন অন্যতম। শিল্পী সমিতির আজকের অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল তারই। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে তিনি জানিয়েছিলেন, শিল্পী সমিতি সবসময়ই তার পাশে ছিলো, আছে, থাকবে। এতে তিনি সবার সামনে শিল্পী সমিতির যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরেছিলেন তাতে আমরা গর্বিত হয়েছি। এমন অসাধারণ একজন মানুষের মৃত্যতে আজ আমরা অভিভাবকহীর হয়ে পড়েছি। তাঁর সঙ্গে অনেক চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। এতো সহায়তাপ্রবণ শিল্পী ছিলেন তিনি যা ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো যাবে না। খল অভিনেতা মিশা সওদাগর বলেন, খলিল ভাই সম্পর্কে কিছু বলার যোগ্যতা আমি রাখি না। তাঁর প্রয়াত হওয়ার খবর পেয়ে আজকে শূটিং বাতিল করে আমি এফডিসিতে চলে এসেছি। আমি শুধু বলব খলিল ভাইয়ের অভিনয় দেখে আমরা এখনও শিখি। তিনি আমাদের শিক্ষকতুল্য। তাঁর মতো অভিনেতা শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীতেও খুব কমই আছে। তাঁকে হারিয়ে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আল্লাহ নিশ্চয় খলিল ভাইয়ের জন্য শান্তির জায়গা নির্ধারণ করে রেখেছেন। অভিনেতা ওমর সানী বলেন, খলিল ভাই একজন পরিপূর্ণ অভিনেতা ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। আমরা তাঁকে কতটা দিতে পেরেছি জানি না, কিন্তু তিনি আমাদের অনেক কিছুই দিয়ে গেছেন। আমরা তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারিনি। তাঁর মৃতুতে আমি খুবই মর্মাহত। চলচ্চিত্র ও টিভি অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস বলেন, একজন ভাল মানুষকে হারালাম। চলচ্চিত্র শিল্পে তাঁর মতো মানুষ আর পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন গুণী মানুষকে হারিয়েছি আমরা। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহ তাঁকে স্বর্গবাসী করুন। প্রসঙ্গত, গতকাল রবিবার সকাল ১০টায় স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত, ৮শ চলচ্চিত্রের অভিনেতা খলিলুল্লাহ খান। বিকেল ৩টায় বিএফডিসিতে প্রথম জানাজা, বাদ আছর মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোড মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মোহাম্মদপুর কবরস্থানে খলিলকে সমাহিত করা হয়।
×