ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ্যাপারেল সামিটের লক্ষ্য ॥ টার্গেট ৫ হাজার কোটি ডলারের পোশাক রফতানি

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

এ্যাপারেল সামিটের লক্ষ্য ॥ টার্গেট ৫ হাজার কোটি ডলারের পোশাক রফতানি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানির লক্ষ্যে ঢাকায় এ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করা হয়েছে। ওই সামিটের উদ্বোধনীতে দেশের তৈরি পোশাক খাতকে ধ্বংসের তৎপরতায় লিপ্ত দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রবিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ঢাকা এ্যাপারেল সামিট’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এই আহ্বান জানান। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক এ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) প্রথমবারের মতো এই সামিট ও এক্সপোর আয়োজন করে। দেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য টেকসই রোডম্যাপ প্রণয়নের লক্ষ্যে ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড এক্সপো ফর বিল্ডিং এ্যান্ড ফায়ার সেফটি-২০১৪’ এবং ‘সেন্টার ফর বাংলাদেশ এ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রির’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ। কিন্তু অনেকে এটা পছন্দ করে না। এ জন্য তারা এ খাতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে পোশাক কারখানার মালিক, শ্রমিক, বিদেশী ক্রেতা ও ভোক্তাÑ সবাইকে সতর্ক থাকার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি।’ শ্রমিক ও মালিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদি কোন সমস্যা হয় সেটা আমরাই সমাধান করতে পারি। কিন্তু অন্যে যেন আমাদের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কোন ষড়যন্ত্র না করতে পারে সেজন্য আমার দেশের সকল মানুষকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের উদ্দেশে বলেন, অনেক ক্রেতা ও তাদের প্রতিনিধিরা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন। আপনারা দাম বাড়ান। তাহলে আমাদের শ্রমিক ভাই-বোনেরা আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের অধিকারী হবেন। তখন সবাই উন্নয়নের সমান অংশীদার হবে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, সমস্যা সমাধান করেছে, আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি-সহায়তা দিয়েছে। আমরা এই সহায়ক ভূমিকা অব্যাহত রাখব। সরকার হিসেবে এটাই আমাদের দায়িত্ব বলে আমরা বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, মাত্র তিন দশকেই বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দেশের প্রধান রফতানি খাত হয়ে উঠেছে। ১৯৮৭ সালে যেখানে বাংলাদেশ ১০ হাজার ডলারের পোশাক রফতানি করত, সেখানে ২০১৩ সালে তা বেড়ে সাড়ে ২৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। পোশাক রফতানিতে বর্তমানে বিশ্বের চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ এ খাতে জড়িত, যাদের একটি বড় অংশ নারী। একইসঙ্গে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, নক্সায় নতুনত্ব আনা এবং নতুন বাজার সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করি, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের পাশে থাকবে। কারণ তাদের কাছে বাংলাদেশের পোশাকই সেরা। এ অবস্থা ধরে রাখতে বিজিএমইএকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সরকার তৈরি পোশাকের বাজার সম্প্রসারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ও জাপান জিএসপির রুলস অব অরজিন শিথিল করেছে। এসব পদক্ষেপের ফলে ভারতে ৪৬টি পণ্য এবং চীনে ৯৮ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। রফতানিকারকদের উচিত, তৈরি পোশাকের নতুন বাজার অনুসন্ধান করা। এ প্রয়াসে সরকার আপনাদের পাশে থাকবে। তিনি বলেন, বিশ্ব বাজারে আমাদের পোশাক রফতানির শেয়ার আরও বাড়াতে হবে। সেই সামর্থ্যও আমাদের আছে। তা বাস্তাবে রূপ দিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আরও বিদ্যুত ও গ্যাস উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছি। বিদ্যুত আমদানির ব্যবস্থা করেছি। বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি। আপনারা বিনিয়োগ বাড়ান। জাতির পিতার ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে ‘ব্যাপক শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি’ করতে হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিনিয়োগের উত্তম পরিবেশ সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। সেই সুযোগ গ্রহণ করার জন্য আমি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ওই বছরই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী। আর আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্য-২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা। তবে এসব লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অবকাঠামো ও শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে অনুষ্ঠানে মত দেন বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকা- ও গতবছর রানা প্লাজা ধসে এক হাজারের বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে কারখানার কর্মপরিবেশ এবং বিদেশী ক্রেতাদের কম দামে পোশাক কিনে বেশি লাভ করার প্রবণতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে। এরপর আমেরিকান ও ইউরোপীয় ক্রেতাদের দুটি জোট এ্যালায়েন্স ও এ্যাকর্ড বাংলাদেশে পোশাক কারখানার নিরাপত্তার উন্নয়নে পরদির্শন শুরু করে। বিজিএমই সভাপতি অনুষ্ঠানে জানান, এ্যালায়েন্স ও এ্যাকর্ড এ পর্যন্ত মোট ২ হাজার ১৯৩টি কারখানা পরিদর্শন করেছে; যার মধ্যে ২৯টি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ‘এর অর্থ হলো- দেশের ৯৮ দশমিক ৬৮ ভাগ কারখানা এখন নিরাপদ ও কর্মক্ষম।’ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অধিকাংশ কারখানাই ত্রুটিমুক্তভাবে পরিচালিত হচ্ছে। অবশিষ্ট কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা উন্নয়নে সংস্কার কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকেই সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।’ বিজিএমই সভাপতি আতিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এবং শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিজিএমই’র ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন চৌধুরী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সেকেন্ড ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম মান্নান কচি। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি অব ইকোনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পার্লামেন্টারি স্টেট সেক্রেটারি হেনস জোয়েচিন ফুচেল, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ডেলিগেশন ফর রিলেশনস উইথ দ্য কান্ট্রিজ অব সাউথ এশিয়ার চেয়ারপার্সন জেন ল্যাম্বার্ট, এ্যালাইয়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স ফর সেফটির চেয়ারম্যান এলেন তুসচার ও এইচএসবিসি ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ফ্রাঙ্কোইচ দ্য মেইকো প্রমুখ। গতকাল ঢাকা এ্যাপারাল সামিটে দুটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে একটি হলো ‘বাংলাদেশ আরএমজি ২০২১-রিচিং ৫০ বিলিয়ন অন ৫০তম অ্যানিভারসারি অব বাংলাদেশ’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এ সময় তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণ বেশি হওয়ার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি একটা লাভবান হতে পারে না। এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ কমানোর বিকল্প নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় সেমিনার হলো ‘ইনফ্রাস্টাকচার দ্য রোড টু চিটাগাং এ্যান্ড বিয়নড’। এতে বক্তরা বলেন, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ কমপক্ষে ৭৪ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নতি কর দরকার। তাহলে মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া সম্ভব। অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তায় মালিকরা সচেতন হয়েছে- এ্যালায়েন্স প্রধান ॥ অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা বিষয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকরা অনেক সচেতন হয়েছে। এ্যাপারাল সামিটে সেমিনার ও নিরাপত্তা সামগ্রী প্রদর্শনীর মাধ্যমে মালিকরা আরও সচেতন হবে। এর আগে বিশ্বের কোথাও এত বড় সামিট হয়নি। এর মাধ্যমে কারখানার পুরোপুরি নিরাপত্তা বিধানে মালিকরা সচেষ্ট হবে বলে জানিয়েছেন এ্যালায়েন্স ফর ওয়ার্কার সেফটির বোর্ড চেয়ার এ্যালান টশার। এ্যালায়েন্সের তত্ত্বাবধানে চলমান ভবন ও অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকা-ের অগ্রগতি সম্পর্কে রবিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সামিটের ফলে গার্মেন্টস খাতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে টশার বলেন, সরকার ও মালিকপক্ষ নিরাপত্তা নিশ্চিত, শ্রমিকবান্ধব হলে অসম্ভব কিছু না। তিনি আরও বলেন, কারখানার মালিকদের কাছে সঠিক নিরাপত্তা সামগ্রী পৌঁছে না দিলে এবং সঠিক ব্যবহার না করলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব না। এ্যালান বলেন, পোশাক শিল্পে অর্থবহ, দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন নিশ্চিত করা এবং কারখানার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন অব্যাহত রাখাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, রানাপ্লাজা ও তাজরীনের দুর্ঘটনার পর পোশাক খাতে ইমেজ পুনরুদ্ধার কাজ চলছে। শ্রমিক মালিকদের দূরত্ব কমাতে হবে। স্থিতিশীল নিরাপত্তা আমরা দেখতে চাই। উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহ সকল ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানান এ্যালান। অনুষ্ঠানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, গার্মেন্টস খাতে অগ্নিনিরাপত্তায় সচেতনতায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, কারখানায় অগ্নি বিষয়ে বিজিএমইএ সঙ্গে যৌথভাবে প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। কারখানায় আগের চেয়ে উন্নতি লাভ করেছে। এ্যালায়েন্স বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহ রবিন বলেন, পোশাক শ্রমিকদের রক্ষায় কারখানা মালিকদের নতুন নিরাপত্তা মানদ-ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের কারখানার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে সঠিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
×