ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার টার্গেট করা হয়েছিল

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার টার্গেট করা হয়েছিল

শংকর কুমার দে ॥ প্রধানমন্ত্রীসহ আরও কয়েকজনকে হত্যা পরিকল্পনার ছক তৈরি করার কথা স্বীকার করেছে বর্ধমান খাগড়াগড়ের জঙ্গীদের বোমা তৈরি ও জঙ্গী প্রশিক্ষক অসমে গ্রেফতারকৃত শাহনুর আলম ডাক্তার। গ্রেফতারের পর শনিবার তাকে কামরূপ মহানগরের সিজেএম আদালতে ১৪ দিন রিমান্ডে নিয়ে পুলিশী হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য দিয়েছে পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থা এনআইএকে। এনআইএ কর্মকর্তারা আদালতে হাজির করার পর বলেন, খাগড়াগড়ের তদন্তে শাহনুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দিদি অন্নপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হত্যার নিশানা ছিল বর্ধমান খাগড়াগড়ে বোমা তৈরিতে জড়িত জেএমবির জঙ্গী গোষ্ঠীর। জেএমবির জঙ্গীদের টাকার উৎসের সন্ধান ও হত্যা পরিকল্পনার ছক তৈরির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জঙ্গী ডাক্তারকে। আন্তর্জাতিক মহলে জেএমবির শক্তিসামর্থ্য সম্পর্কে সাড়া জাগানোই ছিল জঙ্গীদের এ ধরনের নাশকতার উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রপতির পরিবারের ওপর হামলার ছকের কথা জানতে পেরেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে আলোচনায় বসেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার পর জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) বর্ধমান খাগড়াগড়ে ঘাঁটি গেড়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালাতে পারে বলে রিপোর্ট দিয়েছিল গোয়েন্দারা। এখন আর একধাপ এগিয়ে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের কীর্র্ণাহারের পরোটা গ্রামে বসবাসরত রাজনীতি থেকে দূরে থাকা বৃদ্ধা অন্নপূর্ণা বন্দোপাধ্যায়ের ওপর হামলা করার লক্ষ্য করেছিল জঙ্গীরা। দিদির আশীর্বাদ নিতে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন জমা দেয়ার আগে কীর্ণাহারের পরোটা গ্রামে অন্নপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে এসেছিলন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলছেন, প্রণববাবু দেশের রাষ্ট্রপতি। গোটা বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গেই তাঁর ব্যক্তিগত স্তরের সখ্য রয়েছে। কঠোর নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রপতির ওপর কোন আঁচ ফেলার ক্ষমতা এই সন্ত্রাসবাদীদের নেই। কিন্তু তাঁর অত্যন্ত কাছের এই মানুষটির ওপর বড় ধরনের হামলা করে রাতারাতি আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে দেয়াই ছিল জেএমবির লক্ষ্য; যাতে মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠনের তালিকায় কিছুটা ওজন বাড়ে জেএমবির। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বলেছেন, জঙ্গীদের এই ছক নতুন কিছু নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই তারা রাষ্ট্রনেতাদের লক্ষ্য করতে না পেরে তাদের নিকট কোন আত্মীয়-পরিজনকে নিশানা করার চেষ্টা করেছে। গোয়েন্দাদের এই ধরনের রিপোর্টের ভিত্তিতেই রাজনৈতিক কারণে সমালোচনা হওয়া সত্ত্বেও সোনিয়া গান্ধীর জামাতা রবার্ট ভদ্রকে এসপিজি নিরাপত্তা দিতে হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। নির্বাচনী হলফনামায় যশোদাবেনকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করলেও তাঁকে ঘরে তোলেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু যশোদাবেনকেও এসপিজি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। এমনকি, মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখনও মেহসানার এই প্রাথমিক স্কুল শিক্ষিকার ওপর নজর রাখতেন সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে, লাভপুরের মিরিটি গ্রামের পৈতৃক ভিটায় প্রণববাবুর পারিবারিক দুর্গাপুজো বহু দিনের। প্রণববাবু ইউপিএ জমানায় যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন তখন থেকেই তাঁর এই দুর্গাপুজোর ওপর নজর পড়ে সংবাদমাধ্যমের। একবার তৎকালীন মার্কিন বিদেশসচিব কন্ডোলিজা রাইজের ফোনও এসেছিল এই বাড়িতে। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পরে ক্রমশ সংবাদমাধ্যমের আলোয় আসে তাঁর পরিবার, বিশেষ করে তাঁর বড় দিদি অন্নপূর্ণা দেবী। পৈতৃক ভাটেয় পুজো করলেও প্রণববাবু অনেক সময়েই রাত্রিবাস করেন পরোটা গ্রামে, দিদির বাড়িতে। যে বাড়ি থেকে মাত্র আধ কিলোমিটার দূরে নানুরের নিমড়া গ্রামের মাঠপাড়ায় শ্বশুরবাড়ি ছিল খাগড়াগড় কা-ের অন্যতম অভিযুক্ত জামাত সদস্য কওসরের। স্ত্রী জিন্নাতুর ওরফে লক্ষ্মীকে নিয়ে এই বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করত সে। খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরেই নিমড়া গ্রামের বাড়ি থেকে সপরিবার উধাও হয়ে যায় কওসরের শ্যালক কাদের ওরফে কদর গাজি। খাগড়াগড়ে রাসায়নিক বিস্ফোরক সরবরাহ করার অভিযোগে নানুরের কাজি মার্কেটের আমজাদ শেখ ওরফে কাজলকে গ্রেফতার করেছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। আবার খাগড়াগড় বিস্ফোরণে নিহতদের অন্যতম কাজলের পিসতুত ভাই করিম শেখ নানুরেরই কাফেরপুর গ্রামের বাসিন্দা। পরোটা থেকে কাজি মার্কেট আধ কিলোমিটার দূরে। আর কাফেরপুরের দূরত্ব বড়জোর তিন কিলোমিটার। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, জঙ্গীদের কল-রেকর্ড থেকে জানা যাচ্ছে, বর্ধমান ও বীরভূমের ডেরার মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। রাজ্য পুলিশ ও গোয়েন্দারা ছিল অন্ধকারে। কোন কিছুই টের পায়নি তারা এতদিন। খাগড়াগড়ের ডেরায় বোমা বানানোর সরঞ্জাম থেকে বিস্ফোরণটি ঘটার কারণে চোখ খুলে গেছে সবারই। খাগড়াগড়ের ঘটনা না ঘটলে প্রণববাবুর দিদি কিংবা অন্য অনর্থ ঘটে গেলেও আশ্চর্র্যের কিছু ছিল না। জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ যখন খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে নানুরে ধরপাকড় করে, সে সময় অন্নপূর্ণা দেবী বলেছিলেন, আমার বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভাই (প্রণববাবু) দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অস্বতিকর পরিস্থিতি দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের আগেও হয়েছে। তাই ভয় পাচ্ছি না। তবে আশঙ্কা তো হচ্ছেই। প্রণবপুত্র সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় নিমড়া গ্রামে জঙ্গী ডেরার হদিস মেলার পরপরই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে একটি চিঠি লিখে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি কীর্ণাহার পৌঁছে গিয়েছিলেন ৩০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু তাঁর নিরাপত্তা বাড়ানো হয় ২ অক্টোবর থেকে, খাগড়াগড় কা-ের পরে। কেন হঠাৎই তা করা হয়েছিল, তখন বোঝা যায়নি। তবে পরে জানা গিয়েছিল, জঙ্গীরা ওখানে রকেট লঞ্চার তৈরি করছিল। তাঁর কথায়, ‘রাষ্ট্রপতি তিন বাহিনীর প্রধান। কীর্ণাহারে তাঁর বা তাঁর পরিবারের ওপর কোন হামলা হলে রাষ্ট্রের অস্বস্তি হতো, হৈ চৈ পড়ে যেত। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতির পরিবারের ওপর হামলার ছকের কথা জানতে পেরেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে আলোচনায় বসেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ। বৈঠকের পর তাঁরা জঙ্গী কার্যকলাপের বিষয়টি বিশদে জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়। তার পরেই মমতা বন্দোপাধ্যায়কে বিষয়টি জানান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তভার এনআইএ’র হাতে দেয়ার ব্যাপারে শুরুতে রাজ্য সরকার আপত্তি করেছিল। কিন্তু ডোভালের কাছ থেকে জঙ্গীদের পরিকল্পনা জানার পরে মুখ্যমন্ত্রী সুর নরম করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনার ছক ॥ ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) তদন্তের বরাত দিয়ে প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ‘বৃহত্তর ইসলামিক বাংলাদেশ’ গড়ার ষড়যন্ত্র করছিল জেএমবি। এই তথ্যের বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে পারে এনআইএ।
×