ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডিসেম্বর জ্বালিয়ে তুলবে ঘুমন্ত চেতনা?

প্রকাশিত: ০২:৪২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

ডিসেম্বর জ্বালিয়ে তুলবে ঘুমন্ত চেতনা?

একাত্তরের ডিসেম্বর যে কতটা ব্যাপক ও প্রভাব বিস্তারকারী হতে পেরেছিল না জানলে বিশ্বাস করা কঠিন। নানা মত ও দলে বিভক্ত বাংলাদেশের রাজনীতি, তা বুঝতে পারে বলেও মনে হয় না। তখনকার দুনিয়া আর আজকের বাস্তবতার আকাশ-জমিন ফারাক। তখন কোন দেশে কী হচ্ছে? কোন সমাজ বা জাতিতে কী ঘটছে- জানাটা এত সহজ কিছু ছিল না। আজকের মতো না ছিল কম্পিউটার না মোবাইল। মিডিয়া বলতে তখন প্রিন্ট বা মুদ্রণ সংশ্লিষ্ট খবরের কাগজ। দু’একটি রেডিও আর রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টিভি। বাংলাদেশ তখন জন্মায়নি, না ছিল কোন টিভি চ্যানেল বা দৃশ্যমান মিডিয়া। তারপরও একাত্তরের ডিসেম্বর দূরের দেশ অস্ট্রেলিয়াকেও ঘুমিয়ে পড়তে দেয়নি। কী আশ্চর্য! তখন হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার ব্যতীত এ দেশে বাঙালী ছিল না। আর যাঁরা ছিলেন তাঁরা পাকিস্তানী দূতাবাসে কর্মরত অথবা সরকারী দায়িত্বে বেড়াতে আসা ভ্রমণ কিংবা বসবাসরত। এদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বা পক্ষাবলম্বন সহজ কিছু ছিল না। তারপরও এ দেশের মুষ্টিমেয় বাঙালী সে দিন নীরব থাকেনি। আজ যখন অতীতের পত্রপত্রিকা ও তথ্য ঘেঁটে দেখি- বিস্মত হই কী কঠিন ঐক্য আর চেতনাবোধ ছিল একাত্তরে। দেশ-দেশান্তরে সে জাদুস্পর্শে আমরা বিদেশীদেরও জাগিয়ে তুলেছিলাম। সহকর্মী পিটার একবার তাঁর ভাইয়ের গল্প শুনিয়েছিলেন। যে ভাইটি যৌবনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের গৌরবে নিজেকে মহিমান্বিত মনে করতেন। প্রেম ও কবিতা লেখার বয়সে না চেনা, অজানা, দূরের এক দেশে লড়াইরত ছোটখাটো মূলত শ্যামলবরণ মানুষগুলোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টায় মাঠে নেমেছিল পিটারের অগ্রজ। অনেকেই হয়ত জানেন না জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশ নিয়ে গাওয়া গানটি অস্ট্রেলিয়ায়ও গেয়েছিলেন, এ দেশের তারুণ্য সে দিন নেচে গেয়ে আবেগে সংগ্রামে আমাদের সমর্থন যুগিয়েছিল। দীর্ঘকালের যে দু’একজন অভিবাসী এখানে আছেন তাঁদের কাছে শুনেছি কর্নার শপ নামে পরিচিত পাড়ার দোকানগুলোর সামনেও ‘বাংলাদেশ’ সমর্থনের আবেদন জানিয়ে বিলবোর্ড বা পোস্টার আঁটা থাকত। কে জানে হয়ত অজান্তে বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ডের প্রভাব বা ছায়া কাজ করত। তিনিও তো অস্ট্রেলিয়ান, ডাচ-অস্ট্রেলিয়ান এই ভদ্রলোক রীতিমতো যুদ্ধ করেছিলেন আমাদের হয়ে। গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে বাহিনী গড়ে তুলে, তথ্যবিনিময়ে সাহায্য করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মে অবদান রাখা তাঁকে আমরা কতটা মনে রেখেছি? তরুণ প্রজন্মের কাছে নিতান্ত অপরিচিত আর অচেনা একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ডের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় আজ আমাদের সেই ঐক্য বা সময়ের দেশাত্মবোধও নেই। একাত্তরের ডিসেম্বর আর আজকের ডিসেম্বরে যেন আকাশ-পাতাল ব্যবধান। ইতিহাস অর্থনীতি এমনকি জীবনধারায় বাংলাদেশ এখন অগ্রগামী ও স্থিতিশীল একটি দেশ। জন্মলগ্নে ঐক্যবদ্ধ জাতি কেন আজ তবে বিভক্ত ও দ্বন্দ্বমুখর? ডিসেম্বর এলে আমরা বিজয়ের মাস বলে যতই চিৎকার বা গৌরবে উজ্জীবিত হই না কেন মনে রাখা প্রয়োজন এর বাইরেও একটা শক্তি কাজ করছে। আজকের ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে কাউকে চিহ্নিত করার পূর্বে পরিবর্তিত প্রতিক্রিয়াশীলতার চরিত্র উন্মোচন জরুরী। একাত্তরের ডিসেম্বরে শত্রুপক্ষ থাকলেও ছদ্মবেশী কোন প্রতিপক্ষ ছিল না। আজ অনেক প্রগতিবাদী মুখোশের আড়ালে ডিসেম্বরের চেতনাবিরোধী। ছদ্মবেশী প্রগতি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের জোট ডিসেম্বরের অর্জনকে ভয় পায়। মনে রাখতে হবে এরা মার্চ বা অন্য যে কোন অর্জনের চেয়ে ডিসেম্বরকেই এড়িয়ে চলতে চায়। কারণ এই মাসে তাদের পরাজয় ঘটেছিল। কথিত বিশ্বসেরা পাকবাহিনীর ইজ্জত লুটিয়ে পড়েছিল তাসের ঘরের মতো। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের সেই করুণ বিকেলকে রক্তাক্ত করতে চায় তারা। অন্যদিকে এই হচ্ছে আমাদের চরম উজ্জ্বল সময়। ডিসেম্বরকে পত্রিকা বা মিডিয়ার কোনায় আবদ্ধ না রেখে এর গৌরব ও বিজয়ের প্রচার জরুরী। খুব সাধারণভাবেও তা করা সম্ভব। প্রবাসীদের জীবনে ডিসেম্বরের সবচেয়ে বড় স্মারক তাদের প্রবাসী নাগরিকত্ব ও নানান দেশের বর্ণিল পাসপোর্ট। আজ যে আমরা মাথা উঁচু করে বাঙালী ও বাংলাদেশী পরিচয়ে আন্তর্জাতিক সুযোগ ভোগ করছি, সন্তানদের আধুনিক জীবনে বড় করে তুলছিÑ এ সব কিছুর উৎসমূল সেই ডিসেম্বর। সে দিন ঘটনা অন্যদিকে ঘুরলে বা ফলাফল বিপরীত হলে ক্রীতদাসত্ব ইহজীবনেও শেষ হতো না। বাঙালী ও বাংলা সংস্কৃতি, নীতি, ইতিহাস অতীত ও ভবিষ্যতে এমন আর একটি দিন বা মাস নেই, শীঘ্র বা অনতিবিলম্বে যোগ হবারও নয়। সে কারণে কেবল ভাবাবেগ বা অন্ধত্বে নয়, কার্যকরভাবে এর উদ্ভাস ছড়াতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতির বড় সমস্যা জনগণের কথিত মন যুগিয়ে চলার প্রবণতা, আওয়ামী লীগও তার বাইরে না। যে সময় আমরা দিগন্তজোড়া বিজয় এনেছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিই বাঙালীর চিন্তা ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করত। এমন ধারার রাজনীতি তিনি ও তাঁর সতীর্থরা চালু করেছিলেন, ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধে উঠে বাঙালী হয়ে বেঁচেছিলাম আমরা। আজ ঠিক তার উল্টো স্রোত বইছে। সে কোন ব্যাপারে তথাকথিত সমঝোতা আর রাখঢাকে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আদর্শের উজ্জ্বলতা। এবারের ডিসেম্বর কি আমাদের পথ দেখাবে? শিক্ষা, ক্রীড়া, বিজ্ঞান, শিল্প, অর্থনীতি প্রায় সবদিকে অগ্রসর জাতি যদি শেকড়ে না ফেরে দুর্ভোগের অন্ত থাকবে না। বিজয়ের মাসে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তৈরি করতে হবে জাতিকে; দেশে বা প্রবাসে এর কোন বিকল্প এখন আসলেই নেই। কোনভাবে সুযোগ করতে পারলে বাংলা স্থান বানানোর ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না। চৌদ্দ ও ষোলো ডিসেম্বর কি খুব দূরের কিছু? তাই এখনই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়।
×