ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রসনা তৃপ্ত করে, সুস্বাদু ঘরে ঘরে জনপ্রিয় ঔষধি গুণসম্পন্ন

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

রসনা তৃপ্ত করে, সুস্বাদু ঘরে ঘরে জনপ্রিয় ঔষধি গুণসম্পন্ন

তাহমিন হক ববি ॥ মাছে-ভাতে বাঙালীর রসনাতৃপ্ত করার অন্যতম সহজ খাবার হলো শাক। বাপ-দাদার আমল থেকে এখনও বাঙালীর ভোজের তালিকায় শাক থাকেই। বিভিন্নভাবে রান্না করে খাওয়া হয় শাক। শাকের ঝোল বা ঘোণ্ট, শাকভাজা বা চচ্চড়ির মতো পদ লোভনীয়। প্রায় সারাবছরই বিভিন্ন জাতের শাক চাষাবাদ হয়ে থাকে। এর মধ্যে পালং শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক, ডাটা শাক, কচু শাক, লাউ শাক, কুমড়ো শাক, পাট শাক, বাবরিশাক, সরিষার শাক, মূলা শাক, বথুয়া শাক, বুত্তা শাক, দারা শাক, হেলেঞ্চা শাক ইত্যাদি। এসব শাক মানুষের স্মরণশক্তি বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। শীতকালে আরও এক প্রকার শাক পাওয়া যায় শুধুমাত্র ‘বাহের দ্যাশ’ বলে পরিচিত রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে। শাকটি এ অঞ্চলে ‘নাপা’ নামে সকলেই চেনে। এই শাকের পরিচিতি নিয়ে মজার একটি কাহিনী প্রচলিত রয়েছে, যা আজও এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। লাল শাকের টুকটুকে রং সবার মন কেড়ে নেয়। ডুমো-ডুমো আলুর সঙ্গে কলমির ঝোল মন্দ না। শীতে পালংয়ের ঝোল অবশ্য ঢের বেশি লোভনীয়। কচু শাকের ভর্তাও লোভনীয়। কচুর লতি দিয়ে চাপড়া চিংড়ি ভাপা অনবদ্য। সর্ষে শাক দিয়ে ডিম ভাজি- এ যেন আরেকটি মজার খাদ্য। প্রতিটি শাক যেন মৌসুমভিত্তিক খাদ্যের তালিকায় থেকেই যাচ্ছে। শাক ‘নাপা’ এখন ‘বাহের দ্যাশে’ সবার ঘরে ঘরে প্রতিদিনের তরকারি হিসেবে থাকছে। পাওয়া যাবে আগামী দু’মাস। এই শাকের সঙ্গে নতুন আলু ভর্তার কি যে স্বাদ, যেন মুখে লেগেই থাকে। নাপা শাক নিয়ে রংপুর অঞ্চলে একটি ভাওয়াইয়া গানও রচনা করা হয়েছে। খন্দকার মোহাম্মদ আলী সম্রাট গানটি রচনা ও সুর করেন। গানটি এ অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়ও বটে। এই শাক প্রথম রান্না নিয়ে প্রচলিত গল্পটি এ রকম- শীতের কোন এক সময় পুঁটি মাছ ধরে এনে এক গেরস্ত তার বউকে রান্না করতে বলে মাঠে কাজ করতে যায়। বউ মাছ রেখে (১৯ পৃষ্ঠা ৬ কঃ দেখুন) রসনা তৃপ্ত (২০-এর পৃষ্ঠার পর) বাড়ির অন্য কাজ করতে থাকে। এই ফাঁকে বাড়ির হাঁস-মুরগি সেই মাছ খেয়ে ফেলে। গেরস্তের বউ মাছ কাটার জন্য এসে দেখে কোন মাছ নেই। তখন সে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। গেরস্ত বাড়িতে এলে তাঁকে শারীরিক নির্যাতন করবে ভেবে রান্নার জন্য বাড়ির উঠানের পাশে অপরিচিত শাক তুলে রান্না করে রাখে। গেরস্ত বাড়ি ফিরলে বউ তাকে রান্না করা সেই অপরিচিত শাক দিয়ে ভাত খেতে দেয়। গেরস্ত গরম গরম ভাতের সঙ্গে এ শাক খেয়ে খুবই তৃপ্তি পায়। খেতে খেতে বলে, এত সুন্দর শাক খাওয়ার পর অন্য কোন তরকারি খাওয়ার প্রয়োজন নেই। মাছ দিয়ে খাওয়ার কথা সে ভুলে যায়। এতে গেরস্তের বউ তো মহাখুশি। খাওয়ার পর গেরস্ত জানতে চায়- কি শাক, কোথায় পেয়েছে সে এই শাক? বউ বলে উঠানের পাশেই যে গাছগুলো নলপল নলপল করে বেড়ে উঠেছে, সেই গাছের পাতা এই শাক। গেরস্ত বলে নলপল করে যেটা ওঠে তার নাম নাপা। সেই থেকে নাকি এর নামকরণ হয়েছে ‘নাপা’। এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখা কেউ বলতে পারে না। এই শাককে কোথাও নাপা, কোথাও লাপা বলা হয়ে থাকে। এই নাপা শাক দু’জাতের- নাপা বা লাপা ও হাপা। নাপা শাকের পাতা একটু ছোট কাটা কাটা গোল আকৃতির আর হাপা শাকের পাতা বড় বড়, নাপার দ্বিগুণ আকারে হয়ে থাকে। শীতের সময় বপনের দিন থেকে মাত্র দুই মাস এ শাকের আয়ু। তারপর আস্তে আস্তে শুকিয়ে মরে যায়। স্যাঁতস্যাঁতে এবং ছায়াযুক্ত স্থানে বেশি ফলন হয়। কেউ ভাজি করে, কেউ ঝোল করে, আবার অনেকে খাওয়ার সোডা দিয়ে রান্না করে খায়। এই খাবার সোডা দিয়ে রান্না করার পর কোথাও সোলকা, কোথাও প্যালকা, কোথাও ছ্যাকা আবার কোথাও প্যালকানিও বলা হয়ে থাকে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার ও অসমের গোয়ালপাড়া এলাকার মানুষের কাছে এই শাক দারুণ প্রিয়। তবে বাংলাদেশে এই নাপা শাক একমাত্র ‘বাহের দ্যাশে’র ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
×