ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গ্রামে বড় শিল্প কারখানা হচ্ছে না ঋণের যোগান বেশি শহরে

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৪

গ্রামে বড় শিল্প কারখানা হচ্ছে না ঋণের যোগান বেশি শহরে

রহিম শেখ ॥ গ্রামে ব্যাংকের শাখা বেশি হলেও ঋণের যোগান বেশি হচ্ছে শহরে। ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের সাড়ে ৮১ শতাংশ শহরে এবং ৯০ শতাংশ ঋণ নগরের অধিবাসীদের। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ১০টি উপজেলা থেকে মোট ঋণের ৭০ শতাংশ বিতরণ হয়েছে। যদিও ব্যাংকগুলোয় গ্রামের মানুষ অর্থ জমা রেখেছে সাড়ে ১৮ শতাংশ; আর ঋণ পেয়েছে মোট ঋণের ১০ শতাংশ মাত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামে ঋণের যোগান দেয়ার মতো অবকাঠামো না থাকায় টাকা শহরে আসছে। অল্পকিছু অঞ্চলে ব্যাংকিং কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ায় অন্য অঞ্চলে বড় কোন শিল্প গড়ে উঠছে না। ফলে গ্রামের উন্নয়নের পরিমাণ তুলনামূলক কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ৪ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে ৪ লাখ ২৩ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ ঋণ গেছে গ্রামাঞ্চলে। গ্রামের মানুষ ঋণ পেয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১০টি উপজেলা থেকে মোট ঋণের ৭০ শতাংশ বিতরণ হয়েছে। ওই থানাগুলো হচ্ছে ঢাকার মতিঝিল, গুলশান, ধানম-ি, রমনা, তেজগাঁও, উত্তরা, কোতোয়ালি, চট্টগ্রামের কোতোয়ালি, ডবলমুরিং ও নারায়ণগঞ্জ সদর। এর মধ্যে মতিঝিল থেকে ঋণ গেছে সবচেয়ে বেশি ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাপ্ততথ্যে দেখা যায়, সাড়ে ২৫ শতাংশ মানুষ ব্যাংকের ৯০ ভাগ ঋণ ও ৮১ ভাগ আমানতের সুবিধাভোগী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, নতুন অনুমোদন পাওয়া ৯টি ব্যাংকসহ দেশে বর্তমানে রয়েছে ৫৬টি ব্যাংক। এক সময় ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো শাখা খুলত। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন শহরে একটি শাখার বিপরীতে গ্রামে একটি শাখা খোলা বাধ্যতামূলক করেছে। সে অনুযায়ী ব্যাংকগুলো শাখা খুললেও ব্যাংকিং সেবা নিয়ে তারা নির্ধারিত কিছু এলাকার বাইরে যাচ্ছে না। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব ব্যাংকের শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৯০৩টি। এর মধ্যে গ্রামীণ শাখা ৫ হাজার ৪৪টি এবং শহর শাখা ৩ হাজার ৮৫৯টি, যা যথাক্রমে ৫৭ দশমিক ০৬ ও ৪১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৭৩টি। এর মধ্যে গ্রামীণ শাখা ২ হাজার ২৬২টি ও শহর শাখা ১ হাজার ২৭৭টি। এ সময় বেসরকারী ব্যাংকের শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭১৬টি। এর মধ্যে ২ হাজার ২৬৩টি শহরাঞ্চলে ও ১ হাজার ৪৫৩টি গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। বিশেষায়িত ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ১ হাজার ৪৯৬টি। এর মধ্যে ১৭৮টি শহরাঞ্চলে ও ১ হাজার ৩১৯টি গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সময় পর্যন্ত খোলা বিদেশী ব্যাংকের ৭০টি শাখা শহরাঞ্চলে অবস্থিত। এসব শাখার মাধ্যমে আমানত সংগৃহীত হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। তা মোট আমানতের মাত্র ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের কমলগঞ্জ শাখা ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, গ্রামীণ ব্যাংকে আমানতকারীদের রাখা টাকার একটি বড় অংশই রাখা হয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে। এই টাকা তারা শহরে যোগান দেয়। গ্রামে বড় অঙ্কের ঋণ দেয়ার সুযোগ কম। ছোট ছোট অঙ্কের যেসব ঋণ দেয়া হয় সেগুলোর পরিমাণও কম। ফলে গ্রামের টাকা শহরে চলে যায়। আবার শহর থেকে গ্রামে টাকা যাচ্ছে বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণীর আয়ের মাধ্যমে এবং সরকারী ব্যয় বাড়িয়ে। সদ্য প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকগুলোতে এর পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৮০ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত এক বছরে ব্যাংক খাতে ৯২ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা জমা করেছে গ্রাহকরা। মোট আমানতের প্রায় ৮২ শতাংশ শহর থেকে এবং গ্রাম থেকে সোয়া ১৮ শতাংশের বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় মালিকানার ৪ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। তারা ঋণ দিয়েছে ৯৬ হাজার ৩০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলোর মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ১১০ কোটি টাকা। বেসরকারী খাতের ৩৯টি ব্যাংকের মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। তাদের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তাদের গড় ঋণ বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং আমানত বেশি হয়েছে ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। বিদেশী ৯টি ব্যাংকের মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। শহরে ঋণ দিয়েছে ২৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকের মালিকরা অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা প্রভাব খাটিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ দেন কোন কোন ব্যবসায়ীকে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয় না। এভাবে অনিয়ম করে বিতরণকৃত ঋণ পরবর্তীকালে আর আদায় হয় না। এ প্রসঙ্গে মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমীন জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা হলো ভাল গ্রাহক পেলেই সব ব্যাংক তার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সবাই তাকে ঋণ দেয়। নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে এগিয়ে আসছে না কেউ। তবে বর্তমানে ব্যাংকগুলো এই প্রথা থেকে বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এসকে সুর চৌধুরী বলেন, ব্যাংকিং সুবিধা যদি কোন একক অঞ্চল বা খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে ঝুঁকি থেকে যায়। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে বহুমুখী না হয়ে একটি খাত বা একটি অঞ্চলে ঢালাওভাবে ঋণ দিয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি বলেন, সারা দেশের মানুষকে আরও বেশি ঋণের সুফল দিতে কৃষি ও এসএমই ঋণের পাশাপাশি শহরে একটি শাখার বিপরীতে গ্রামে একটি শাখা খোলার বিষয়ে নীতিমালা জারি করা হয়েছে।
×