ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ

আজিজুর রহমান অনন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৫ ডিসেম্বর ২০১৪

আজিজুর রহমান অনন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা

বৃহত্তর দিনাজপুর তথা উত্তরবঙ্গের রাজনীতিতে পরিচিত নাম মোঃ আজিজুর রহমান। স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ মার্চ ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। প্রবাসী সরকার সুনিয়ন্ত্রিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন হলে মুজিবনগর সরকার এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ৭নং সেক্টর এবং ৬নং সেক্টরের অর্ধেক অঞ্চলের জন্য লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার পদে দায়িত্ব প্রদান করে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার হিসেবে তাঁর সদর দফতর ছিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত তরঙ্গপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। সেই গোপন পরিপত্র অনুয়ায়ী ওই সেক্টরের সামরিক কমান্ডার এবং অধীনস্ত সকলের জন্য তাঁর নির্দেশ মানাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দেয়ার এখতিয়ার তাঁর ছিল। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাঁর সামরিক বিষয়ে প্রদত্ত পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সেক্টর কমান্ডারকে জানানোর নির্দেশ ছিল। ওই সেক্টরের সকল মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই পদ মর্যাদায় মোট দশজন নিযুক্ত ছিলেন এবং সকলেই ছিলেন এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য)। তিনি তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে ১৯২০ সালের ১ নবেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম আলেকজান নেসা। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাঁর বিপ্লøবী পিতা মাওলানা আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে তিনি স্কুলজীবনে ১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া শেষে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে তিনিও সেখানের ছাত্রত্ব শেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে নিজ ভূমিতে ফিরে এসে দেশগড়ার কাজে হাত দেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শিষ্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (বর্তমান ছাত্রলীগ) সভাপতি দবিরুল ইসলাম দিনাজপুরে রাজনৈতিক সভা থেকে গ্রেফতার হলে, তিনি ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ১৯৫০ সালে আইনজীবী হিসেবে দিনাজুপর বার কাউন্সিলে যোগদান করে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার নির্বাচনে ঘোড়াঘাট থেকে তেঁতুলিয়া প্রায় দুই শ’ কিলোমিটারের মতো এই বিস্তৃত অঞ্চলে অক্লান্তভাবে সাংগঠনিক পরিশ্রম করেন। তাঁর আগুনঝরা বক্তৃতায় মানুষের চোখ খুলতে শুরু করে। এরই পাশাপাশি জনতার মাঝে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগাতে তিনি বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ১৯৫৫ সালে সাপ্তাহিক আওয়াজ নামে সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। তাঁর অকুতোভয় প্রবল কর্মকা-ে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তিনি ১৯৭০ সালে বৃহত্তর দিনাজপুরের আসন থেকে এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য, ঠাকুরগাঁও, বালিয়াডাঙ্গি, রানিশংকৈল এবং হরিপুর থানা) নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিলে প্রতিবাদী জনতা নেমে আসে রাজপথে। শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে তিনি দিনাজপুর আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি হিসেবে সকল দলের নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনতাকে দৃপ্তভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেন। যুদ্ধের শেষধাপে দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য শিলিগুড়ির ভারতীয় ক্যান্টনমেন্টে তিনি জেনারেল জগজিত সিং আরোরার সঙ্গে মিলিত হন। তারই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অকুতোভয় নেতা মিত্রবাহিনীর অগ্রগামী দলের সঙ্গে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার গৌরবের পতাকা উড়িয়ে দেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা উত্তর সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্যের (এমএনএ) মর্যাদার বদলে এমসিএ (কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যাসেমব্লি অব বাংলাদেশ) হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে নিয়োজিত হন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সকল (১৬৭ জন) পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এবং ৩০০ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) মিলিয়ে সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে এমসিএ (কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যাসেমব্লি অব বাংলাদেশ) হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই বীর যোদ্ধা, অকুতোভয় জননেতা মোঃ আজিজুর রহমান তাঁর মেধা, সাহস আর সংগ্রামের জন্য আগামী প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন।
×