ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ সুবহানের মামলার রায় যে কোন দিন

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৫ ডিসেম্বর ২০১৪

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ সুবহানের মামলার রায় যে কোন দিন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষে হয়েছে। রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছে। যে কোন দিন রায় প্রদান করা হবে। একই মামলায় বাগেরহাটের কসাই সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষী শৈলেন্দ্র নাথ দাশ (৭০) জবানবন্দীতে বলেছেন, সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ৬০ জনকে হত্যা করে। জবানবন্দী শেষ সাক্ষীকে আংশিক জেরা করা হয়। রবিবার পুনরায় জেরার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে নেত্রকোনার মুসলিম লীগ নেতা আতাউর রহমান ননি (৬২) ও নেজামে ইসলামের ওবায়দুল হক তাহেরের (৬৪) বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ (চার্জ) গঠনের শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে ১১ ডিসেম্বর। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ আদেশগুলো প্রদান করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছে। যে কোন দিন রায় ঘোষণা করা হবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বৃহস্পতিবার এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবার রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। বৃহস্পতিবার পাল্টা যুক্তিতর্কে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আব্দুস সুবহানের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ও তার হাতে নির্যাতিত-ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। আব্দুস সুবহানের মামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ মোট চারটি মামলা রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রাখা হলো। সুুবহানের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি প্রসিকিউশনের ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুস সুবহানের ভূমিকার জন্য তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- চেয়েছেন প্রসিকিউশন পক্ষ। বৃহস্পতিবার আসামিপক্ষের যুক্তিতর্কের জবাবে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আব্দুস সুবহানের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ও তার হাতে নির্যাতিত-ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। তিনি বলেন, আব্দুল কাদের মোল্লার আপীল মামলায় উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, অপরাধী যে অপরাধ করেছেন তাতে তিনি কোন ক্ষমা পেতে পারেন কিনা সেটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। একজন অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের (ভিকটিম) ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি অপরাধীর শাস্তির বিষয়ে সমাজের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন এবং ভবিষ্যতে সমাজকে এ ধরনের অপরাধ সংঘটন থেকে বিরত রাখার বিষয়টিও যেন বিবেচনায় নেন। এমন কথা বলবেন না ॥ চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন বলেন, উভয়পক্ষই বেশ ভাল যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু উভয়পক্ষের উদ্দেশ্যেই বলছি, সংবাদ মাধ্যমে আপনারা অনেক কথাই বলে থাকেন। কিন্তু এমন কথা বলবেন না, যাতে আদালতের মর্যাদা, সম্মানহানি ঘটে। আদালতের কর্তৃত্বকে খর্ব করে। এমন কথা বলা উচিত নয়, যে কথা আদালতকে আঘাত করে। তিনি আরও বলেন, আদালতের সম্মান, মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্ব উভয়পক্ষের আইনজীবীদেরও। তাছাড়া আদালত কেবল অপরাধীদের বিচারই করেন না, আদালত অবমাননাকারীর বিচারও করেন। সবাইকে ধরার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে। ননী-তাহের ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত নেত্রকোনার নেত্রকোনার মুসলিম লীগ নেতা আতাউর রহমান ননী (৬২) ও নেজামে ইসলামের ওবায়দুল হক তাহেরের (৬৪) বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ (চার্জ) গঠনের শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে ১১ ডিসেম্বর। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বৃহস্পতিবার এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। কসাই সিরাজ ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত বাগেরহাটের কসাই সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী শৈলেন্দ্র নাথ দাস (৭০) জবানবন্দীতে বলেছেন, সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী তাদের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা চালিয়ে আনুমানিক ৫০-৬০ জনকে হত্যা করে। এছাড়াও তার চাচাতো ভাইসহ গ্রামের আরও কয়েকজন হিন্দুকে হত্যা করে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দী প্রদান করেছেন। এ সময় সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সাইয়েদুল হক সুমন। শৈলেন্দ্র নাথ দাস তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, আমরা সংবাদ পাই যে রাজাকার ঐ বাহিনীর লোকজন ১৩ মে ১৯৭১ তারিখে আমাদের গ্রামে আক্রমণ চালাবে। ঐ দিন সকাল আনুমানিক ১০ ঘটিকার সময় রাজাকার বাহিনীর লোকজন আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী যৌখালী নদীর অপর পাড়ে খানপুর গ্রামে জমায়েত হয়। আমাদের গ্রামের ৪০০-৫০০ লোকজনকে পাহারারত দেখে রাজাকার বাহিনীর লোকজন ঐ সময় চলে যায়। ‘ঐ দিন দুপুর ২ ঘটিকার সময় পাহারারত লোকজন অধিকাংশই দুপুরে খাওয়ার জন্য নিজ নিজ বাড়িতে গেলে ঐ সময় ১৫০-২০০ রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ আমাদের গ্রামে আক্রমণ চালায়। আমাদের গ্রামে ঢুকেই তারা মনিন্দ্র নাথ দাস মেম্বারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে গোলাগুলি করা শুরু করে। এই সময় আমাদের গ্রামের লোকজন আত্মরক্ষার জন্য রণজিৎপুর হাইস্কুলের পেছনে আনুমানিক ২০-২৫ বিঘা জমির ওপর একটি বাগান ছিল। ঐ বাগানের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে’। শৈলেন্দ্র নাথ দাস বলেন, আমি এবং আমার চাচাতো ভাই গোবিন্দ্র চন্দ্র দাস আত্মরক্ষার জন্য ঐ বাগানে ঢোকার চেষ্টাকালে আসামি সিরাজুল হক তার হাতে থাকা রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার উক্ত ভাই গোবিন্দ্রের মাথায় আঘাত করে। ঐ আঘাতের ফলে গোবিন্দ্র মাটিতে পড়ে গেলে আসামি সিরাজ মাস্টার হাতে থাকা ছোরা দিয়ে তার বুকে ঘাই মেরে হত্যা করে। ঐ সময় দু’জন রাজাকার আমাকে দুই পাশ থেকে দুই হাত ধরে এবং আসামি সিরাজ মাস্টার ছোড়া দিয়ে আমার গলা থেকে পেট পর্যন্ত পোজ দিয়ে জখম করে (সাক্ষী তাঁর জখমের চিহ্ন ট্রাইব্যুনালে দেখান)। আসামি সিরাজ মাস্টার আমার শিক্ষক ছিলেন, তাকে আমি চিনতাম, তাকে আমাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করলেও তিনি ছোড়া দিয়ে আমাকে ঐ পোজ দেন। অপর দুই রাজাকার আমার শরীর থেকে কাপড়-চোপড় খুলে নেয়। আমার উলঙ্গ শরীর দেখে সিরাজ মাস্টার পড়ে থাকা একটি গামছা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলে ‘শালাকে গামছা দেও’। এরপর আমার সামনেই আসামি সিরাজ মাস্টার তার হাতে থাকা ছোড়া দিয়ে আমাদের গ্রামের নিশিকান্ত, নকুল দাস, নির্মল দাস, সোনাতন দাসকে হত্যা করে এবং মনিন্দ্রনাথ দাসকে গুলি করে হত্যা করে। আসামি সিরাজ মাস্টাসহ রাজাকার বাহিনীর লোকজন আমাদের গ্রামের ও গ্রামে আশ্রয় নেয়া লোকজনদের মধ্যে আনুমানিক ৫০-৬০ জনকে হত্যা করে। এদের মধ্যে আমাদের গ্রামের ২৪ জন ছিল। বিকেল আনুমানিক ৫ ঘটিকার সময় ঐ রাজাকার বাহিনীর লোকজন ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিতে দিতে আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। সন্ধ্যার পর অন্ধকার হলে গ্রামের লুকিয়ে থাকা লোকজন গ্রামে এসে তাদের আত্মীয়-স্বজন যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের লাশ সন্ধান করেন। আমি আমার চাচাতো ভাই গোবিন্দ্রের লাশটি ঘটনাস্থলেই মাটি খুঁড়ে চাপা দেই। অনেক লাশ পরদিন স্কুলের মাঠের সামনে আশপাশের গ্রামের লোকজন এসে মাটি খুঁড়ে চাপা দেয়। ঐ স্থানটি এখন বদ্ধভূমি হিসেবে চিহ্নিত।
×