ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্থায়ন সঙ্কটে বিলম্বিত হচ্ছে বিদ্যুতের বড় প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৫ ডিসেম্বর ২০১৪

অর্থায়ন সঙ্কটে বিলম্বিত হচ্ছে বিদ্যুতের বড় প্রকল্প

রশিদ মামুন ॥ বিদ্যুতখাতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থসংস্থানকেই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। মান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে সরকারী প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেও বেসরকারী অনেক প্রতিষ্ঠানই অর্থসংস্থান করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ছে। অন্যদিকে যৌথ বিনিয়োগে কয়লাচালিত বড় বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রিতা লক্ষ্য করা গেছে। যদিও (জি টু জি) দুই দেশের রাষ্ট্রীয় কোম্পানির মধ্যে সমন্বয়ের জন্যই অতিরিক্ত সময় ব্যয় হচ্ছে বলে মনে করা হয়। কেন্দ্র নির্মাণ এবং সঞ্চালনে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রায় ৪৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। বিপুল এ অর্থসংস্থানে বেসরকারী উদ্যোক্তাদের সহায়তায় তহবিল গঠনের পরামর্শ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। দেশের স্বল্পমেয়াদী বিদ্যুত সমস্যা সমাধানের পর এখন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। তবে এর জন্য সব থেকে বেশি জরুরী বিপুল পরিমাণ অর্থের সংস্থান করা। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চাইলেও বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না বেসরকারী বড় প্রকল্পে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন শুধু কাজ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না। এসব ক্ষেত্রে বেসরকারী উদ্যোক্তাদের সহায়তায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। যাতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা স্বাচ্ছন্দবোধ করেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় দেখা যায় ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনে ৪০ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এ সময় বিদ্যুত সঞ্চালনখাতে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার (সাত দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। এছাড়াও সরকারের মোট পরিকল্পনার মধ্যে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির কথা বলা হয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে ব্যয় নির্ধারণ হয়নি। ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির অবকাঠামো রয়েছে। এর বাইরে ভারত থেকে আরও ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে আগামী বছর ডিসেম্বর নাগাদ ত্রিপুরা থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হবে। বিদ্যুত দেয়ার বিষয়ে ত্রিপুরা সরকার সম্মত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশ যৌথ স্টিয়ারিং কমিটি বিদ্যুত আমদানির জন্য সঞ্চালন লাইনের নক্সা অনুমোদন করেছে। কাঠমা-ু সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে প্রতিক্ষিত বিদ্যুত চুক্তি হওয়ায় নেপাল-ভুটান এবং ভারতে জলবিদ্যুত উৎপাদন এবং তা এ অঞ্চলে সঞ্চালন করা আরও সহজতর হবে। উপরন্তু দেশগুলো জ্বালানি সংকট সমাধানে একযোগে কাজ করবে। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ক্রস বর্ডার ইলেক্ট্রিসিটি ট্রেড (বিদ্যুত বাণিজ্য) নতুন মাত্রা পাবে। চলমান প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সরকার তার গত মেয়াদে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের জন্য দেশীয় দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। এদের কেউই এখনও পর্যন্ত বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারেনি। দুটি ক্ষেত্রেই অর্থায়নকে জটিলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বড় কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ অর্থায়ন সংগ্রহ করা প্রয়োজন তা আদৌও তারা পারবে কি না সন্দেহ রয়েছে। প্রতিমাসেই বিদ্যুত বিভাগ চলমান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনায় বৈঠক করে। তাতে এসব কোম্পানির কর্ণধাররা নানা আশার বাণী শোনান বটে তবে কাজের কাজ কিছুই এখনও করতে পারছেন না। আপাতত জমি কেনা আর আংশিক মাটি ভরাট আর প্রযুক্তি পছন্দর মধ্যে তাঁরা সীমাবদ্ধ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানান, আমাদের উচিত ছিল বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেকে এনে কাজ দেয়া। আমাদের দেশে বিদ্যুতের ভাল বাজার রয়েছে। স্থিতিশীল অবস্থায় বিপুল শিল্পবিনিয়োগের জন্য বিদ্যুত জ্বালানি সংকট সমাধান জরুরী ছিল। সেক্ষেত্রে ওইসব বিদ্যুতকেন্দ্র যথাসময়ে উৎপাদনে আসলে আমরা উপকৃত হতাম। কিন্তু তা যখন করা হয়নি তাই সরকারের উচিত দেশীয় এসব কোম্পানির পাশে দাঁড়ানো। বিদেশী লগ্নিকারীরা যেন আমাদের দেশীয় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে চায় তার কোন না কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। যা করা হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি। ওই কর্মকর্তা বলেন, আমি ওকে কাজ দিয়েছি তার মানে আমার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে এমন নয়। কারণ ওই কোম্পানি নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুতকেন্দ্র আনতে না পারলে আমাদের বেশি দামে তরল জ্বালানিতে উৎপাদিত বিদ্যুত কিনতে হবে। আর এতে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি জানতে চাইলে পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির বলেন, সরকারের উচিত একটি ফান্ড (তহবিল) তৈরি করা। অন্তত দুই থেকে তিন বিলয়ন ডলারের এ তহবিল থেকে এ ধরনের উদ্যোক্তাকে সরকারীভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে দেখলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাণিজ্যিকভাবে তাদের ঋণ দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে। তাতে প্রকল্পগুলোর অর্থায়নের জটিলতা কেটে যাবে। আর যেহেতু বিদ্যুত সরকারের কাছেই বিক্রি করা হয়। তাই ঋণ ফেরত নিয়েও সরকারের কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, বেসরকারী উদ্যোক্তারা ব্যর্থ হলেও সরকার সঠিক পথে রয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে জাইকা ছাড়া এখনও কেউ সরকারকে অর্থ প্রদানের স্বীকৃতি দেয়নি। দুই (জি টু জি) দেশের সঙ্গে আলোচনায় বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হচ্ছে। গত সরকারের প্রথম দিকে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত হয়। বিদ্যুত কেন্দ্রটি ২০১৫তে প্রথম উৎপাদন শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিদ্যুত কেন্দ্রটির দরপত্রই আহ্বান করতে পারেনি ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ কোম্পানি। যেহেতু বিডার্স ফাইনান্সে (দর পাওয়া কোম্পানির মাধ্যমে অর্থসংস্থান) বিদ্যুতকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে তাই দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থসংস্থানের বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠান ফিশনারকে দরপত্র প্রস্তুতের কাজ দেয়া হয়েছে। শীঘ্রই দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে জানা গেছে। এখন বলা হচ্ছে ২০১৮ তে রামপালের প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) পটুয়াখালিতে আরও একটি এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। সম্প্রতি বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য যৌথমূলধনী কোম্পানি গঠন করেছে কোম্পানি দুটি। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রামপাল প্রকল্পের কাজ অনেক আগে শুরু হলেও আমরা আশা করছি পটুয়াখালির বিদ্যুত কেন্দ্রটির একটি ইউনিট রামপালের আগেই উৎপাদনে আসবে। এছাড়া সুন্দরবন এবং অন্যান্য ইস্যুতে পরিবেশবাদীদের যে বিরোধিতা তা পটুয়াখালিতে নেই বলে জানান তিনি। ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা দরপত্র প্রস্তুত করার জন্য পরামর্শক নিয়োগ দিতে আবার দরপত্র প্রক্রিয়ায় না যাওয়ার চিন্তা করছি। এক্ষেত্রে রামপাল প্রকল্পর জন্য যাদের দিয়ে দরপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে তাদের নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এতে অন্তত ছয় মাস সময় বেঁচে যাবে। অন্যদিকে কক্সবাজারের মহেশখালিতে আরও একটি বড় বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে দেশীয় কোম্পানি কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড। জাইকা এ প্রকল্পে বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দিয়েছে। কেবলমাত্র এ একটি বড় প্রকল্পের অর্থায়নের নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে বলে বিদ্যুত বিভাগ জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার পাশাপাশি কয়লার দামও ব্যাপকভাবে পড়ে গেছে। এছাড়া বেশি কয়লা ব্যবহারকারীদের মধ্যে চীন অন্তত ৫০ ভাগ কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কয়লার চেয়ে সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশটি পারমাণবিক বিদ্যুতের পাশাপাশি জলবিদ্যুত উৎপাদনে মনোনিবেশ করছে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাংলাদেশের কয়লা পাওয়াটা দুষ্কর হবে না। সবশেষ হিসেব বলছে টন প্রতি ৮২ ডলারের কয়লার দাম এখন ৬০ ডলারে নেমে এসেছে। এতে করে কয়লা বিদ্যুতের যে দাম আগে হিসেব করা হয়েছে তা আরও কমে আসবে। অন্যদিকে ২০১৭ সাল নাগাদ ১৬ বিদ্যুতকেন্দ্রের উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। গ্যাসচালিত এ সব বিদ্যুতকেন্দ্রের মধ্যে নয়টির অগ্রগতিকে সন্তোষজনক বলছে বিদ্যুত বিভাগ। আর অন্যগুলোর ক্ষেত্রে বলার মতো তেমন কোন অগ্রগতি নেই। অগ্রগতি ভাল থাকা বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো হচ্ছে সামিট-এর মেঘনাঘাট- ৩৩৫ মেগাওয়াট। বিদ্যুতকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করেছে। সামিট-এর বিবিয়ানা-৩৪১ মেগাওয়াটের অর্ধেক কাজ শেষ। এছাড়া সিরাজগঞ্জ-৩৩৫ মেগাওয়াটের ৭০ ভাগ, আশুগঞ্জ-২২৪ মেগাওয়াটের ৯০ ভাগ, একই স্থানে আরও একটি ৪৫০ মেগাওয়াটের ৭৬ ভাগ, একই স্থানে একই ক্ষমতার আর একটি বিদ্যুতকেন্দ্রের ২৮ ভাগ, আশুগঞ্জ-২০০ মেগাওয়াটের ৭০ ভাগ, ভেড়ামারা-৩৬০ মেগাওয়াটের ২০ ভাগ, ভোলা ২২৫ মেগাওয়াটের ৫০ ভাগ, শাহাজিবাজার ৩৩০ মেগাওয়াটের ১৪ ভাগ, গাজীপুরের কড্ডা-১৫০ মেগাওয়াটের ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া বিবিয়ানা-৩ নম্বর ইউনিটের প্রায় দুই ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ঘোড়াশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঘোড়াশাল রিপাওয়ারিং এবং শিকলবাহার বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর নির্মাণ শুরু হয়নি।
×