ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাসপাতালের প্রতিটি স্তরে অনিয়ম ;###;পিসিসিইউর একটি বেড বিক্রি হয় কয়েক দফা;###;শয্যা ৪১৪টি, রোগী থাকে প্রায় ৮শ’;###;সীমিত চিকিৎসা উপকরণ, অতি পুরনো অবকাঠামো

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ॥ বাড়তি টাকা না গুনলে চিকিৎসা মেলা ভার

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৫ ডিসেম্বর ২০১৪

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ॥ বাড়তি টাকা না গুনলে চিকিৎসা মেলা ভার

নিখিল মানখিন ॥ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চলছে নানা অনিয়ম। ভেঙ্গে পড়েছে হাসপাতালের স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম। চরম দুর্ভোগের শিকার রোগীরা। পদে পদে দিতে হয় উৎকোচ। কর্মচারীদের খুশি না করলে সিট মেলে না। জরুরী বিভাগ থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত যেতেই ব্যয় হয় দেড় থেকে দু’শ’ টাকা। টাকা না দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও প্যাথলজিসহ বিভিন্ন পরীক্ষার সিরিয়াল পাওয়া যায় না। বেলা দু’টার পর হাসপাতালে অবস্থান করেন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা । বহির্বিভাগে রোগী দেখাতে চিকিৎসকের সিরিয়াল পেতেও গুনতে হয় বাড়তি টাকা। স্বল্প ব্যয়ের সরকারী চিকিৎসা গ্রহণ করতে গিয়ে রোগীদের বহন করতে হয় একটি বেসরকারী হাসপাতালের সমান চিকিৎসা ব্যয়। এতে ক্ষুণœ হচ্ছে স্বাস্থ্য সেক্টরের অর্জিত সুনাম। আর সরকারী চিকিৎসাসেবার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে, বাড়ছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। হার্ট স্ট্রোকে আক্রান্ত নীলিমা চিরানকে ভর্তি করানো হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে তার শরীর। স্বজনদের কান্নার রোল পড়ে গেছে। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার মনিকুড়া গ্রামে তার বাড়ি। ভর্তি হওয়ার তিন ঘণ্টা পরও ডাক্তার ও নার্সের দেখা নেই। টাকা দিলে সিটের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে জানিয়ে গেলেন এক কর্মচারী। জরুরী বিভাগ থেকে দোতলায় ওঠানোর জন্য ট্রলিম্যান ইতোমধ্যে দেড়শ’ টাকা নিয়ে গেছেন । চার ঘণ্টা চিকিৎসাবিহীন কাটানোর পর নীলিমা চিরানকে একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করাতে বাধ্য হলেন তার স্বজনরা। শুধু নীলিমা চিরান নন, প্রত্যেক রোগীকেই হাসপাতালের এমন অব্যবস্থাপনার শিকার হতে হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালে পুরোদমে চলছে রমরমা সিটবাণিজ্য। সিটের ভাড়া ১৫ টাকা হলেও একটি সিট পেতে গুনতে হচ্ছে ২ থেকে ৫শ’ টাকা। হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মীরাই ভিজিটরদের কাছ থেকে প্রবেশ ফি বাবদ নিচ্ছেন ৫ থেকে ২০ টাকা। হাসপাতালের পোস্ট করোনারি কেয়ার ইউনিটের (পিসিসিইউ) একটি বিছানা দিনে কয়েক দফা বিক্রি হওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। টাকা ছাড়া মিলছে না হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীদের ইনজেকশন কার্ডিনেক্স। পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব, বরাদ্দকৃত অর্থের অপব্যবহার এবং দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে হাসপাতালে। দালালদের উৎপাত এবং অনিয়ম-অব্যবস্থপনার চিত্র সর্বত্র। প্রতিনিয়ত চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে রোগীরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অপেক্ষাকৃত কম খরচে রোগ নির্ণয় ও সুচিকিৎসা পাওয়ার আশায় প্রতিদিন রোগীর ভিড় বাড়ছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। প্রতিদিন ১ হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে এই হাসপাতালে। হৃদরোগীদের জন্য সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও মাত্রাতিরিক্ত রোগীর চাপে হাসপাতালের অবস্থা বেসামাল। এখানে শয্যা সংখ্যা ৪১৪ টি। রোগী থাকে প্রায় আট শ’। আছে ৩৮ শয্যার সিসিইউ, ২৬ টি কেবিন ও ৭ টি ওয়ার্ড। হৃদরোগীদের জন্য হাসপাতালের জরুরী বিভাগ ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে বলে দাবি করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের সম্মুখভাগ কিছুটা পরিচ্ছন্ন হলেও ভেতরে বিরাজ করছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বাড়তি টাকা আদায়, প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসক ও নার্সদের না পাওয়া নিয়েই বেশি অভিযোগ। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের রোগী শাহ আলম (৫৬) জানান, তিনি বুকের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর ছেলে রমিজ অভিযোগ করেন, এ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে কর্মচারীদের টাকা না দিলে কোন কাজ হয় না। তাঁর বাবাকে হৃদরোগ হাসপাতালে আনা হলে প্রথমে পাঠানো হয় পিসিসিইউতে। সিট খালি নেই বলে জানিয়েও পরবর্তীতে ৩শ’ টাকার বিনিময়ে সিটের ব্যবস্থা করে দেয় ওয়ার্ডবয় ক্বারী নুরুল ইসলাম। প্রায় ৩ ঘণ্টা পর রোগীকে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। ওই ওয়ার্ডেও সিট পেতে টাকা গুনতে হয়েছে। সেখানে ওয়ার্ডবয় মালেক সিটের জন্য ৫শ’ টাকা দাবি করলে ২শ’ টাকায় সিটের ব্যবস্থা হয় বলে জানান রোগী শাহ আলমের ছেলে রমিজ। চিকিৎসাধীন রোগী আলেহা বেগম জানান, অনেক কষ্টে সিট পেয়েছি। কিন্তু ঠিকমতো ওষুধ মিলে না। নার্সদের ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তাছাড়া মহিলা ওয়ার্ডে অবাধে পুরুষ লোক প্রবেশ ও অবস্থান করেন বলে আলেহা বেগমের অভিযোগ। সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা গেছে, রোগীদের সঙ্গে বাড়তি মানুষের অভাব নেই। প্রতিটি ওয়ার্ডেই বাথরুমের অবস্থা বেহাল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই। রোগীদের বিছানাসহ ওয়ার্ডজুড়ে যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা। হাসপাতালের অধিকাংশ জায়গায় বিরাজ করছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ওয়ার্ডে সঙ্কট আছে পর্যাপ্ত বাতি ও ফ্যানের। ছারপোকা, তেলাপোকা এবং বিড়ালের উৎপাত যেন বাড়িয়ে দিয়েছে রোগীদের অস্বস্তি ও দুর্ভোগ। হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হলেই ১০ থেকে ১২ টি কার্ডিনেক্স ইনজেকশন দেয়া হয়। বাইরে একটি ইনজেকশনের দাম ৫শ’ টাকা। প্রায় সব ক’টি ওষুধসহ বিভিন্ন মেডিক্যাল উপকরণ বাইরে থেকে কিনে থাকেন রোগীরা। অভিযোগ পাওয়া গেছে, আগে হার্ট এ্যাটাক রোগীদের জন্য জরুরী চিকিৎসা কার্ডিনেক্স ইনজেকশন পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ ছিল। প্রয়োজনীয় সব রোগীর মধ্যে সরবরাহ করা হতো। এখন সীমিত সরবরাহ থাকায় বিশেষ সুপারিশ ছাড়া তা দেয়া হয় না। হাসপাতালের প্রশাসনের জড়িত এক চিকিৎসক এই সুপারিশ করে থাকেন। সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা গেছে, চিকিৎসা উপকরণ ও আধুনিক অবকাঠামোর অভাবে স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালের ৫টি ক্যাব ল্যাবের মধ্যে ২টি নষ্ট হয়ে পড়েছে। ৪শ’ বেডের বিপরীতে প্রতিদিন ভর্তি থাকছে প্রায় ৮শ’ রোগী। সিসিইউ, আইসিইউ, পিসিইউ, ওয়ার্ড, কেবিন, ক্যাথ ল্যাব ও অপারেশন থিয়েটারের আধুনিকায়ন জরুরী হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি আরও আধুনিক ও অধিকসংখ্যক ইকো-কার্ডিওগ্রাফি মেশিন, ইটিটি, সি-আর্ম, এমআরআই, পিইটি, ভেল্টিলেট ও মনিটরের ব্যবস্থা করা দরকার। সীমিত চিকিৎসা উপকরণ ও অতি পুরনো অবকাঠামো দিয়ে চিকিৎসাসেবা প্রদানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসক ও কর্মচারী নেতৃবৃন্দের অহেতুক হস্তক্ষেপের কারণেও ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালের স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা। চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালের চারপাশে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নামিমের নির্দেশ থাকার কারণে উচ্ছেদের পর ওই সব অবৈধ স্থাপনা পুনরায় গড়ে তোলার চেষ্টা কেউ করেননি বলে জানালেন হাসপাতালের কর্মচারীরা।
×