ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের বাঁধ নির্মাণ ॥ মৃত্যুপথে যমুনা

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৫ ডিসেম্বর ২০১৪

ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের বাঁধ নির্মাণ ॥ মৃত্যুপথে যমুনা

শাহীন রহমান ॥ পদ্মার মতোই পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম প্রধান নদী যমুনা। এর মূল স্রোতধারা ব্রহ্মপুত্র নদের চীনের অংশে বাঁধ নির্মাণের ফলে বিশেষজ্ঞরা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, সম্প্রতি চীনের ইয়ারলুং সাংপো নদীতে (তিব্বত অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র) একটি জলবিদ্যুত প্রকল্প চালু করেছে। আরও চারটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ব্রহ্মপুত্রের ৬০ শতাংশ পানি আসে চীন ও ভুটান থেকে। সেই চীনের অংশে পাঁচটি বাঁধ নির্মাণ করা হলে দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত যমুনার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে নদীভাঙ্গন, নদীর গতিপথ পরিবর্তনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য উজানের ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সারা বছরই আটকে রাখতে হবে। পানি আটকে রাখা ছাড়া বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব নয়। পানি আটকে রাখার ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ নদীর পানিপ্রবাহ অনেক কমে যাবে। এছাড়া চীনের বাঁধের প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে ভারতের পক্ষ থেকে বাঁধ নির্মাণের আশঙ্কা রয়েছে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র থেকে তিস্তা এবং তিস্তা থেকে গঙ্গা নদীর উজানে পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ভারতের অনেক দিনের। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পদ্মার চেয়ে করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে দেশের বৃহৎ নদী যমুনার। পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, দেশের পানি সম্পদের অর্ধেকেরই যোগান আসে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে। এছাড়া শীতকালে দেশের নদীগুলোর প্রয়োজনীয় পানির ৭৫ ভাগই যোগান দিয়ে থাকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। তাঁর মতে, পানি সম্পদের ৪৯ ভাগ আসছে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে। ৩৩ ভাগ গঙ্গা অববাহিকা থেকে। আর মেঘনা অববাহিকা থেকে আসে মাত্র ১২ শতাংশ পানি। গঙ্গা নদীর ভারতীয় অংশে অজস্র ড্যাম, ব্যারাজ ও সেচ প্রকল্প থাকায় উজানে পানি আটকে রাখা হয়। ফলে শীতকালে গঙ্গা থেকে পানি কম আসে। বর্ষার আগে ছাড়া গঙ্গা অববাহিকা থেকে কোন পানি পাওয়া যায় না। এর বিপরীতে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গঙ্গা নদীর তুলনায় চাষের জমি কম থাকায় এবং ব্যারাজ না থাকায় বসন্তের শুরুতেই হিমালয়ের বরফগলা পানি ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। কিন্তু গঙ্গা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পেতে বাংলাদেশের বর্ষাকাল লেগে যায়। তিনি বলেন, সারা বছর বিদ্যুত পেতে হলে নদীর পানি আটকে রাখা ছাড়া জলবিদ্যুত উৎপন্ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু চীনের সাংপোয় এ বাঁধের ফলে ব্রহ্মপত্র অববাহিকা দিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হবে। এছাড়া এর অববাহিকায় জনজীবন, প্রকৃতি ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জলধারা সনদ ১৯৯৭ অনুযায়ী বাংলাদেশকে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক সব নদীতে ভারত বাঁধ দিয়ে রেখেছে। একমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর কোন বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। সম্প্রতি চীনের বাঁধ নির্মাণের ফলে আগামী শুষ্ক মৌসুমে যমুনার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি, নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও ভাঙ্গনপ্রবণতা অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একমাত্র যমুনা নদীর পানিপ্রবাহের আন্তর্জাতিক কোন হুমকি ছিল না। কিন্ত চীনের বাঁধ দেয়ার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ এ নদীর পানি প্রবাহে হুমকির সৃষ্টি হলো। দেশের মধ্য দিয়ে যেসব নদী বয়ে গেছে তার মধ্যে পদ্মার বুকে অনেক আগেই ফারাক্কার মতো মরণ বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া মেঘনার মূল প্রবাহেও টিপাইমুখের মতো প্রকল্প নিয়ে রেখেছে ভারত। এ কারণে শীতকালে এবং শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা অববাহিকা ও মেঘনা অববাহিকা থেকে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বাঁধের কারণে ভরা বর্ষায়ও পদ্মার প্রবাহ ২০ ফুট নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে তার শাখা-প্রশাখা শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মায় বাঁধ দেয়ার পর এর অববাহিকায় প্রায় ৫ কোটি লোকের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নদীতে পানি না থাকায় লাখ লাখ জেলে পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। নদীতে পানি না থাকায় নৌপথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এবার এই পরিণতির শিকার হতে চলেছে যমুনারও। ২০০৬ সালে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে পদ্মার গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে। তাঁদের মতে ফারাক্কা বাঁধের কারণে নদীভাঙ্গন ও ভাটি অঞ্চলে পলি জমে যাওয়ার পাশাপাশি এ নদীর মূল গতিপথও পরিবর্তন হচ্ছে। কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের তৈরি ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলÑগঙ্গা নদী প্রতিবছরে ৭০ কোটি টন পলি বহন করে। এর মধ্যে ৩০ কোটি টনই আটকে যায়। এ কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম পানি আসার কারণে প্রতিবছর পদ্মা শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। আবার বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির কারণে ভাঙ্গনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের ওপর বাঁধ নির্মাণের ফলে একই অবস্থার সৃষ্টি হবে যমুনাতেও। চীনের ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে অনেক আগেই বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছিল। তখন আপত্তির মুখে চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চীনের বাঁধ নির্মাণে ভাটি অঞ্চলে কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু এই বাঁধ তৈরির পর আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এর প্রভাবে বাংলাদেশ ও ভারত চরম হুমকিতে পড়বে। ইতোমধ্যে ভারতের বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, চীনের সাংপো নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে সংযুক্ত নিচু এলাকায় বন্যা, খরা ও ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেবে। ভারতের পক্ষ থেকে বাঁধটিকে বিপজ্জনক হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন ব্রহ্মপুত্রের ওপর বাঁধ নির্মাণের ফলে এখন ভারত থেকেও এ নদীর ওপর বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি করা হলে বাংলাদেশের জন্য আরও বিপদের কারণ হবে। এছাড়া ভারতের অংশে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বাঁধ না থাকলেও এর প্রায় ২০ উপনদীতে বাঁধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এশিয়া মহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাশ শৃঙ্গের কাছের জিমা ইয়ংজং হিমবাহ থেকে, যা তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। তিব্বতে সাংপো নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে অরুণাচল প্রদেশ দিয়ে সিয়ং নামে ভারতে প্রবেশ করেছে। তারপর অসমের ওপর দিয়ে দিহং নামে বয়ে যাবার সময় এতে দিবং এবং লোহিত নামে আরও দুটি বড় নদী এর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। সমতলে এসে চওড়া হয়ে এর নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। এটি ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য ২৯০০ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা হচ্ছে যমুনা। ব্রহ্মপুত্র যাত্রাপথে ভারতের ভেতর দিয়ে ৮শ’ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আরও ৫শ’ কিলোমিটার পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এক সময় ব্রহ্মপুত্র নদ ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে দেশের ভেতরে প্রবাহিত হয়ে ভৈরবের কাছে মেঘনায় মিলিত হতো। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, ১৭৮৭ সালে ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথ পরিবর্তন করে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়। ১৭৭৯ সালের মানচিত্রে ব্রহ্মপুত্রকে মেঘনায় মিলিত হওয়ার তথ্য রয়েছে। কিন্তু ১৮৩৪ সালের ম্যাপে যমুনা নদীকে ব্রহ্মপুত্রের একটি প্রধান শাখা হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশস্ততম ব্রহ্মপুত্র নদ এখন অনেকটা শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন কারণে এই নদী দেশের সবচেয়ে ভাঙ্গনপ্রবণ। এর করালগ্রাসে বাস্তুভিটা হারায় লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু চীনের অংশে সম্প্রতি বাঁধ নির্মাণ করায় নদীটির প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে হঠাৎ বন্যা, নদীভাঙ্গনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও বেড়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক পানি ও নদী বিশেষজ্ঞ ড. এসআই খান উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে প্রবেশের আগে গঙ্গায় ৬৫ শতাংশ পানি আসে নেপাল থেকে, ১০ শতাংশ পানি আসে চীন থেকে, বাকি ২৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। একইভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ব্রহ্মপুত্র নদের ৬০ শতাংশ পানি আসে চীন ও ভুটান থেকে। বাকি পানি আসে ভারত থেকে। তবে যে হারে নদীগুলোর ওপর বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মরুভূমি হয়ে যাবে। পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ইনামুল হকের মতে, ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তাসহ বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃনদী সমূহের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীর পানির অভাবে দেশ ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবে পানি বাধাগ্রস্ত হলে বাংলাদেশও এক সময় মরুভূমিতে পরিণত হবে।
×