ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিকড়ের সন্ধান

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪

শিকড়ের সন্ধান

একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তার সহযোগীদের পাশবিকতা, বীভৎসতার স্মারক হয়ে আছে সে। যুদ্ধদিনের নারকীয়তার শিকারও সে। যদিও মনে নেই সেই ভয়াবহ মুহূর্তগুলো। মনে থাকার কথাও নয় ফুটফুটে সেই শিশুটির। কিন্তু মুছে যায়নি যুদ্ধদিনের ক্ষত। যার চিহ্ন আজও বহন করছে সে দেহে-মনে। যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে তার জন্মদাত্রী মা জননীকে যিনি হানাদারের পাশবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের বলি। শিশুটিও পায়নি রেহাই বেয়নেটের খোঁচার। ধর্ষিত জননীর সন্তান সে। তার নাম হয়ে গেছে ‘যুদ্ধশিশু’। জানে না সে কোথায় তার স্বজন, কোথায় তার জননীর ধাম। ৪৩ বছর আগে ছেড়ে যাওয়া দেশ, মাটি, মাতৃকার টান তাকে ফিরিয়ে এনেছে শিকড়ের সন্ধানে। মনোয়ারা ক্লার্ক, একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদারদের পাশবিকতার শিকার সে। হাল্কা-পাতলা গড়নের স্বাধীনতার সমান বয়সী মেয়েটি। বেড়ে ওঠার পর জেনেছে সে পালক পিতা-মাতার কাছে জন্মের বৃত্তান্ত। শুনেছে ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তানী হানাদারদের নারী নির্যাতন সেলের পাশ থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। হানাদারদের বেয়নেট চার্জে নিহত মায়ের পাশে ক্রন্দনরত শিশুটিকে উদ্ধারের পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত মাদার তেরেসা হোমসে রাখা হয়। তখনও শিশুটির শরীরে বেয়নেটের ক্ষত থেকে ঝরছিল রক্ত। এখান থেকেই তাকে দত্তক নেন কানাডার ভ্যাঙ্কুবারের এক দম্পতি লিন্ডা ও ক্লার্ক। দত্তক দেয়ার সময় হোমস তার নাম রাখে মনোয়ারা। পারিবারিক পরিবেশে পিতা-মাতার স্নেহ মমতায় সে বেড়ে ওঠে। কিন্তু এক সময় তারা তাকে তাড়িয়ে দেয়। তখন বয়স তার ১২। সেবার আশ্রয় পায় মার্গারেট নিকল নামের এক সন্তানবৎসল নারীর কাছে। যিনি মাতৃস্নেহ ও ভালবাসায় তাকে লালন-পালন শেষে বিয়ে দেন। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত হয়নি মনোয়ারা। মায়া মমতার গভীরতা স্পর্শ করেছে এই মায়ের কল্যাণেই। মনোয়ারা নিজেও এক সন্তানের জননী আজ। নিজের মাকে দেখেননি, ভালবাসাও মেলেনি, ঠাঁই পাননি নিজ দেশেও। সেই মনোয়ারা তাঁর সন্তান জুলিয়াকে গভীর ভালবাসায় পরিপূর্ণ করতে চান। মনোয়ারা ক্লার্ক স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসেছেন নিজ মাতৃভূমিতে। খুঁজছেন পরিবার-পরিজন, যা আসলে অসম্ভবের নামান্তর। মাদার তেরেসা হোমস যুদ্ধশিশুদের জন্মদায়িনীদের নাম-ঠিকানা রাখেনি, ফলে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া লৌকিকভাবে অকল্পনীয়। যুদ্ধশিশুরা নানা দেশে দত্তক হিসেবে আশ্রয় পেয়েছিল সেদিন। সমাজ তাদের গ্রহণ করেনি। যুদ্ধশিশুদের সামাজিকভাবে স্বদেশে বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও পরিস্থিতি তখনও দূরঅস্ত। তাই সরকার তাদের দত্তক প্রদানে সাগ্রহ সম্মতি জানিয়েছিল। যুদ্ধশিশুদের যেসব মায় বিপর্যস্ত হয়েও বেঁচেছিলেন, তাঁদের পুনর্বাসন করা গেলেও শিশুদের লালন-পালন ছিল দুঃসাধ্য। পাকিস্তানী হানাদারদের বর্বরতার নিদর্শন হয়ে আছে এই যুদ্ধশিশুরা। প্রায় ৪৩ বছর বয়সী এই যুদ্ধশিশুদের সংখ্যাও অজ্ঞাত। অনেক দেশেই তাঁরা বসবাস করছেন। কখনও কখনও কেউ কেউ শিকড়ের সন্ধানে ছুটে আসছেন জন্মভূমিতে। দু’একজন হদিস পেয়েছেন তাঁদের স্বজনদের। কিন্তু এ দেশে বসবাস করার অবস্থা ও অবস্থান না থাকায় তাঁরা ফিরে গেছেন। সর্বশেষ মনোয়ারা এসেছেন ক’দিন আগে। ঢাকার রাস্তায় ঘুরছেন। সাক্ষাতপ্রার্থী সরকারপ্রধানসহ মন্ত্রীদের। প্রশ্ন তাঁর একটাইÑ কেন জন্মভূমি, সমাজ, রাষ্ট্র তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছে? মনোয়ারা ক্লার্ক একাত্তরের পাকিস্তানী হানাদার ও তার সহযোগীদের পাশবিক নিপীড়নেরই ফসল। নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ সে সব যুদ্ধশিশুদের প্রতি মমতার হাত বাড়ানো আজকের দিনে আর অকল্পনীয় নয়। রাষ্ট্র ও সরকারই পারে যুদ্ধশিশুদের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশসহ সহানুভূতি জাগাতে। একাত্তরের প্রতীক মনোয়ারার প্রতি সবার সহমর্মিতা থাকুক অটুট।
×