ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেলের ওপর ভীমরতির আছর

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪

রেলের ওপর ভীমরতির আছর

বাংলাদেশের যোগাযোগ ক্ষেত্রে রেল ও নৌপথ ছাড়া প্রকৃত উন্নতি কখনও সম্ভব নয়। ব্রিটিশরা এ জন্যেই এ নদীনালার দেশেও রেল ব্যবস্থা গড়েছিল। নৌপথেও করেছিল সুরক্ষিত যাতায়াতের সুবিধা। ব্রিটিশরা আমাদের শোষণ করেছে; কিন্তু তারা আমাদের মতো অশিক্ষিত, দুশ্চরিত্র ও দুর্নীতিবাজ নয়। তারা শিক্ষিত, দক্ষ ও সৎ ছিল। তাই তাদের সময় এগুলো সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তান আমল থেকে এগুলো ধ্বংসের কাজ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু আবার গড়ে তোলার জন্যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। আমরা শুধু দুশ্চরিত্র ও দুর্নীতিবাজ নই, বেইমান ও ইতরও। তাই বঙ্গবন্ধুকে আমরা হত্যা করি। শেষ করে দেই বাংলাদেশকে। জিয়া এবং এরশাদ নামক দুই পাকিস্তানী এ দেশ ও জাতির কত ক্ষতি করেছে সে হিসেবের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কোন একদিন বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত উন্নত বাঙালী জাতি যদি হয় তাহলে তারা প্রকৃত চিত্র সেদিনের জাতিকে জানবে। সেদিন এ দেশে অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে, বেরিয়ে আসবে সিরাজুল আলম খান, মোশতাক, জিয়া, কর্নেল তাহের, এরশাদ- এমনকি আব্দুর রাজ্জাক সকলে মিলে এ জাতির কত ক্ষতি করেছে। আর বর্তমানে তো আরেক পাকিস্তানী খালেদা জিয়া আছেই। এই দুর্ভাগা দেশের একমাত্র আশা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করে তিনি বাংলাদেশকে ভাল করতে চান। তাঁর পরিচয় এখন আর শুধু বঙ্গবন্ধুকন্যা বা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভেতর সীমাবদ্ধ নেই। তিনিই এখন সার্কের প্রধান নেতা। দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর কাছাকাছি কোন নেতা নেই। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও দেশের সমস্যা উপলব্ধি করেন। ভাল করতে চান। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্ত বেশি ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয় না। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরে তিনি রেলপথ ও নৌপথের উন্নতি করতে চান। জোর দেন বেশি রেলপথের দিকে। রেল এগোয়নি কাক্সিক্ষত হারে। বাস্তবে এগোবে কিভাবে? প্রথমে রেলের দায়িত্ব পান বাংলাদেশের একটি চিহ্নিত ব্র্যান্ড সৈয়দ আবুল হোসেন। সত্য কথা বলতে কি রেলপথের উন্নতির থেকে তার ধান্ধা ছিল কিভাবে চীনের সঙ্গে ব্যবসা করা যায়। ডেমু ট্রেন থেকে শুরু করে একের পর এক শ্বেতহস্তী ছাড়া আর কোন উন্নতি নেই। এর পরে এলেন ছোট দলের বড় নেতা বাংলাদেশের রেলের কালো বিড়াল সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। মন্ত্রী হবার আগে খুব লম্বা লম্বা কথা বলতেন। ছোট দলের নেতাদের এটা স্বভাব। জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ এই যত গয়রহ পার্টি আছে এদের নেতাদের এটাই স্বভাব। সবার ভাবখানা এমন স্রষ্টার পরে তিনিই সৎ। বাস্তবে এদের চরিত্র সম্পর্কে খুব সংক্ষিপ্ত একটি বাক্যে প্রকাশ করেছিলেন কবি সাইয়ীদ আতিকুল্লা ভাই। এক আড্ডায় বসে ছোট পার্টির এক নেতা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, অমুক খুব সৎ নেতা, টাকা খায় না। আতিকুল্লা ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, ‘কত পর্যন্ত খায় না’। আতিকুল্লা ভাই যে শতভাগ সঠিক তা এখন আওয়ামী লীগে মতিয়া চৌধুরী ছাড়া বাদবাকি যত কমিউনিস্ট বা ছোট পার্টির নেতা আছে তাঁরা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তবে হ্যাঁ, তাদের নিয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারে না এ কারণে যে, আওয়ামী লীগ নেতাদের চরিত্র আর বড় দলের বা দেশ গড়ার দলের নেতার চরিত্র নেই। তাদের অধিকাংশই মুখে বঙ্গবন্ধু বললেও তাদের প্রকৃত আদর্শ ‘ফালু’। কিভাবে ফালুর মতো টাকা রোজগার করা যায় সেটাই তাদের লক্ষ্য। ফালু যেমন কবরস্থানের জমিও ছাড়েনি। এরাও তেমনি জামায়াতের টাকা নিতেও পিছপা হয় না। সৎ যে নেই তা নয়। তবে যাঁরা আছেন এখনও তাঁরা নেতৃত্ব পান না। তবে এঁরাই আওয়ামী লীগের এখনও অস্তিত্ব। শেখ হাসিনার ভাষায় তাদের কারণে এখনও মানুষ আওয়ামী লীগ করে। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। নইলে যে আওয়ামী লীগ নেতারা অফিস খুলে হিন্দুদের জমি দখল করে, রিক্সাওয়ালাদের কাছ থেকে প্রতিদিন দশ টাকা করে যাদের নামে চাঁদা ওঠে, তারপরেও নেতা থাকে। সে আওয়ামী লীগ মানুষ কেন করবে? যাহোক, রেলের কালো বিড়াল মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বুঝিয়ে দিলেন, তিনি ছোট পার্টির নেতা। তাই শত কোটি নয়, হাজার কোটি নয়, মালি, ঝাড়ুদারদের কাছ থেকে সত্তর লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে তিনি আপাতত বড় সার্কাস দলের ক্লাউনের ভূমিকায় আছেন। প্রতিদিন সার্কাস পার্টির ক্লাউনের মতো নানান কসরৎ করে শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। সত্তর লাখ টাকার বস্তায় ওই কালো বিড়াল বিদায় হবার পরে আপাত দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের। তিনি রেলের জন্যে কাজ করার সময় পাননি। এরপরে আসেন বর্তমানের এই মুজিবুল হক। ভদ্রলোক দায়িত্ব নেয়ার পরেই পড়েন বিপর্যয়ের মুখে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তখন জামায়াত-বিএনপি দেশের বিরুদ্ধে আরবান গেরিলা ওয়ার শুরু করেছে। প্রায় প্রতিদিন তারা রেলপথ, রেলের কোচ ধ্বংস করছে। হত্যা করছে রেলযাত্রীকে। ওই সময়ে রেলমন্ত্রী বা বাংলাদেশের কোন মন্ত্রীরই ওইভাবে কোন ভূমিকা ছিল না। খালেদা জিয়া দেশের বিরুদ্ধে যে আরবান গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিল শেখ হাসিনা দক্ষ সেনাপতির মতো দৃঢ়তা নিয়ে তা মোকাবেলা করেন। এবং গোটা পৃথিবীকে তাঁর নেতৃত্বের ক্যারিশমা দেখিয়ে দিয়ে তিনি আবার সরকার গঠন করেন। সরকার গঠন করার পরে আবার তিনি রেলের দায়িত্ব দেন মুজিবুল হককে। কিন্তু এবার দায়িত্ব নেয়ার পরে গত আট মাসের বেশি সময় ধরে দেখা গেল তিনি সত্তর বছর বয়সে প্রেম ও বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। তার প্রেম ও বিয়ে নিয়ে যা তিনি করলেন সেটা রুচিহীনতার এক চরম পরিচয়। তবে তা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু শেখ হাসিনার এবারের পাঁচ বছরের একটি বছর রেলের উন্নতির কী হলো! প্রথম পাঁচ বছর রেলকে কাক্সিক্ষত পথে এগুতে দিল না ট্রেড মার্ক আবুল হোসেন, কালো বিড়াল ও খালেদা-জামায়াত। আর এই পাঁচ বছরের একটি বছর নষ্ট হলো রেলমন্ত্রীর ভীমরতিতে। শুধু ভীমরতি নয়, এই বিয়ের ভেতর দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের সৎ কর্মীদের কাছে প্রমাণ করেছেন তিনি সৎলোকও নন। আওয়ামী লীগের এক তরুণ নেতা অনেক দুঃখ করে বলল, এদের মতো নেতা ও মন্ত্রী থাকতে নেত্রী একা কী করবেন? এরা সবাই মিলে তো নেত্রীকে শেষ করে দিচ্ছে। অথচ দেখেন আমাদের অনেক বড় নেতা বিএনপির সঙ্গে গলা মিলিয়ে এইচ টি ইমামের বিরুদ্ধে কথা বলেন। অথচ তারা এইসব অপকর্ম দেখতে পান না। এর পরে গলায় আরো বিরক্তির স্বর এনে ওই তরুণ নেতা বলে, এই যে রেলমন্ত্রী ২৫ হাজার লোক নিমন্ত্রণ করে বৌভাত করলেনÑ টাকা পেলেন কোথায়? ওই তরুণ নেতার ভাষায়, কিছুদিন আগেও যার ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে কুত্তা দৌড় দিত, তিনি এখন পঁচিশ হাজার লোক নিমন্ত্রণ করে বৌভাত করছেন। আর এই দায় বইতে হবে শেখ হাসিনাকে? বঙ্গবন্ধুর কূটনীতি সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, শেখ মুজিব গাঁয়ের ছেলে, তিনি জানতেন কত সের ধানে কত সের চাল হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিও ছিল তাই। রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু বুঝতেন, কত সের ধানে কত সের চাল হয়। শেখ হাসিনাও গাঁয়ের মেয়ে। তিনিও নিশ্চয়ই এ হিসাবটি বোঝেন। তাই এখন খুব সহজে হিসাব করা যায়, আর যাই হোক এই ব্যক্তির দ্বারা রেল কেন কোন কিছুরই কোন উন্নতি আর সম্ভব নয়। বরং দেশের ও মানুষের কল্যাণের জন্যে, শেখ হাসিনার সরকারের কল্যাণের জন্যে দরকার যত দ্রুত সম্ভব এই ব্যক্তিকে সরকার থেকে, মন্ত্রিত্ব থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা। যিনি পঁচিশ হাজার লোক খাইয়ে বিয়ে করেছেন, তিনি ও তাঁর তরুণী ভার্যা মিলে আগামী দিনে রেলকে কতটা ফোকলা করবেন এই সত্য বুঝতে কোন বই পড়ার মনে হয় দরকার হয় না। গবেষণারও দরকার নেই। তবে রেলমন্ত্রীর এ নিয়ে আমাদের মতো অতি সাধারণের ওপর রাগ করার কোন কারণ নেই। আমাদের মতো লোকের লেখাতে আপনার মন্ত্রিত্বের কোন ক্ষতি হবে না। বরং আপনি প্রমোশনও পেতে পারেন। কারণ, আওয়ামী লীগ যখন সরকারে থাকে বা সুবিধায় থাকে তখন আমাদের কথাগুলো তাদের কাছে খারাপ লাগে। এবং আমাদের শত্রুই মনে করে। আওয়ামী লীগের আমাদের কথা ভাল লাগে যখন ২০০১ নেমে আসে, ২০০৪ নেমে আসে বিএনপি-জামায়াতের কালো ডানায় করে, আওয়ামী লীগের (তবে সংস্কারবাদীদের নয়) আমাদের কথা ভাল লাগে ১/১১ এলে, পাঁচ সিটি কর্পোরেশনে পরাজয়ের পরে যখন অধিকাংশই জামায়াত-বিএনপির দিকে পাল তোলে সেই সময়ে। এখন আমাদের মতো মানুষের লেখায় মাননীয় রেলমন্ত্রী আপনার কোন ক্ষতি হবে না। বরং যারা জামায়াত-বিএনপি ও আইএসআইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে তারা চোস্ত জবাব দেবে, এসব কথা আওয়ামী লীগের ক্ষতি করার জন্যে বলছে। তাদের যেমন প্রতিদিন উন্নতি হচ্ছে আপনারও উন্নতি হবে। তবে সত্য হলো, ‘সময় বহিয়া যায়’, সময় বসে থাকে না। মানুষ ভোটের দিকেও না তাকিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে দেশের উন্নতির জন্যে। বিশ্ব পরিম-ল, গণতান্ত্রিক পরিম-ল আওয়ামী লীগকে মেনে নিয়েছে এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিবেচনায়। এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রথম দরকার কানেকটিভিটি। আর তার জন্যে সবার আগে দরকার রেলের উন্নতি। প্রথম পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ পারেনি। পরবর্তী পাঁচ বছরের এক বছর চলে গেল মন্ত্রীর ভীমরতিতে। বাকি চার বছরের জন্যে কোন শুভ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমরা লালনের সহজিয়া ধর্মের মানুষ। লালনের সহজ ভাষায় বুঝি, সময় গেলে সাধন হবে না।
×