ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবারের উৎসবে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের মতো বিশ্বের নামী দামী সঙ্গীতজ্ঞদের সম্মিলন ঘটেছে। শ্রোতারা উপভোগ করেছেন বিশ্ব বরেণ্য সঙ্গীতজনদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা

কিংবদন্তি শিল্পী ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদে মুগ্ধ শ্রোতা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪

কিংবদন্তি শিল্পী ওস্তাদ আমজাদ আলী  খানের সরোদে মুগ্ধ শ্রোতা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী বার্ষিক বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব শেষ হলো সোমবার। গত দু’বছর ধরে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের এই উৎসব এরই মধ্যে শিল্পী ও দর্শক অংশগ্রহণের বিচারে সারা বিশ্বে উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের সবচেয়ে বড় আসর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এবারের উৎসবে বিশ্বের নামী দামী সঙ্গীতজ্ঞদের সম্মিলন ঘটেছে। শ্রোতারা উপভোগ করেছেন বিশ্ব বরেণ্য সঙ্গীতজনদের মুগ্ধকর পরিবেশনা। প্রবাদপ্রতিম ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদবাদন ছিল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের শেষ পরিবেশনা। কিংবদন্তি শিল্পী ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদের তানে মুগ্ধ হলো হাজার হাজার শ্রোতা। অনুষ্ঠানে তিনি রাগ খাম্বাজ, ভৈরবী এবং যোগিয়া পরিবেশন করেন। তবলায় ছিলেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার এবং পাখওয়াজে প-িত ফতেহ সিং গাঙ্গানি। ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। পঞ্চম দিনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হলো উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখা এবং প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে আয়োজিত এই উৎসবটি। এবারের উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছিল পল্লীকবি জসীমউদ্দীনকে। বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ও পরিচর্যায় অমূল্য অবদানের জন্য স্মরণ করা হয়েছে সদ্যপ্রয়াত বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজা বেগম, গুরু রামকানাই দাস এবং সংস্কৃতিকর্মী ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সুবীর চৌধুরীকে। এর আগে আর্মি স্টেডিয়ামে উৎসবের পঞ্চম ও শেষ দিনের আয়োজন শুরু হয় সোমবার সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে। পঞ্চম দিনের স¦ আয়োজন ছিল বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। শুরুতেই সম্মিলিত কণ্ঠে বাংলা গানের কোরাসে অংশ নেন অদিতি মহসিন, অনিন্দিতা চৌধুরী, আজিজুর রহমান, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বুলবুল ইসলাম, চন্দনা মজুমদার, ইলোরা আহমেদ শুক্লা, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, ফরিদা পারভীন, ইফফাত আরা দেওয়ান, জান্নাত-ই-ফেরদৌস, ঝুমা খন্দকার, খায়রুল আনাম শাকিল, কিরণ চন্দ্র রায়, লাইসা আহমেদ লিসা, মাসুদা নার্গিস আনাম, মিতা হক, মহিউজ্জামান চৌধুরী, নাসিমা শাহীন, প্রিয়াঙ্কা গোপ, শাহীন সামাদ, শাহীন কবির পলাশ, শামা রহমান, শারমিন সাথী ইসলাম, সেমন্তী মঞ্জরি, সুবির নন্দী, সুমা রানী রায়, তানিয়া মান্নান, ইয়াসমিন মুসতারী এবং ইয়াকুব আলী খান। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’, ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’, ও ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’- এই তিনটি গান পরিবেশন করেন তাঁরা। এরপর বিশাল কৃষ্ণ পরিবেশন করেন কত্থক নৃত্য। শিব বন্দনা, পরনের বিভিন্ন প্রকার, তেহাই, পাঁচ গণনার বিভিন্ন কম্পোজিশন এবং ময়ূরের গত পরিবেশন করেন। তাঁকে কণ্ঠে সহযোগিতা করেন দেবাশিস সরকার, সেতারে জয়ন্ত ব্যানার্জী, তবলায় কুশল কৃষ্ণ, বল পঠনে ছিলেন মহান কৃষ্ণ মিশ্র। পরিবেশনা শেষে বিশাল কৃষ্ণের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ফাহিম হোসেন চৌধুরী। বিশাল কৃষ্ণের পরিবেশনের পর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের পঞ্চম দিন সমাপনী অধিবেশন শুরু হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপার্সন ফজলে হাসান আবেদ, কেসিএমজি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। এ সময় অনুষ্ঠানের অতিথিরা চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে স্মরণ করেন। এরপর ছিল প্রবাদপ্রতীম কণ্ঠ শিল্পী বিদুষী কিশোরী আমানকারের পরিবেশনা। তিনি রাগ কেদার ও দরবারি কানাড়া পরিবেশন করেন। তাঁর সঙ্গে তবলায় ছিলেন ভারত কামাত, বেহালায় মিলিন্দ রায়কার, কণ্ঠ সহযোগিতা করেন নন্দিনী বেদেকার ও তেজশ্রী বিভাস আমানকার এবং হারমোনিয়ামে ছিলেন শ্রীয়োগ কুন্ডালকার। বিদুষী কিশোরী আমানকারের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। এরপর মঞ্চে আসেন বাংলাদেশী শিল্পী মনিরুজ্জামান। তিনি বাঁশিতে রাগ বাগেশ্রী বাজিয়ে শোনান। তাঁর সঙ্গে তবলায় ছিলেন ইফতেখার আলম প্রধান, পাখওয়াজে সুসেন কুমার রায়। শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন সঙ্গীত শিল্পী সুবীর নন্দী। অশ্বিনী ভিডে দেশপান্ডে পরিবেশন করেন রাগ যোগ এবং রাগ পরজ। তাঁর সঙ্গে তবলায় ছিলেন প-িত যোগেশ শামসি, হারমোনিয়ামে গৌরব চট্টোপাধ্যায়। শিল্পীর হাতে স্মারক তুলে দেন ভাষা ও ব্যাকরণবিদ জামিল চৌধুরী। উদয় ভাওয়ালকারের ধ্রুপদ ছিল পরবর্তী পরিবেশনা। তিনি রাগ বেহাগে আলাপ ও ধামার এবং সুরতালে বান্দিস পরিবেশন করেন। তাঁর সঙ্গে পাখওয়াজে ছিলেন প্রতাপ আওয়াধ, কণ্ঠ সহযোগিতা করেন চিন্তন উপাধ্যায়। শিল্পীর হাতে স্মারক তুলে দেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে সরোদে দর্শক- শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন ওস্তাদ আমজাদ আলী খাঁ। গোয়ালিয়র ঘরানার জীবন্ত কিংবদন্তি সরোদিয়া ওস্তাদ আমজাদ আলী খাঁ প্রথমবারের মতো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে বাজালেন। আগের দুবারের উৎসবে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে তিনি নিজের অভিমানের কথা বলেছেন। আমজাদ আলী খাঁকে না পেয়ে অতৃপ্তি ছিল ঢাকার দর্শক শ্রোতাদেরও। সোমবার রাতের শেষ ভাগে উৎসবের সর্বশেষ শিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠে হাজার হাজার শ্রোতার করতালিতে যেন সব অভিমান ভুলে গেলেন শিল্পী আমজাদ আলী। আক্ষেপ ঘুচে গেল উপস্থিত শ্রোতাদেরও। সর্বশেষ শিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠে আমজাদ আলী খাঁ তাঁর বাজনা সদ্য প্রয়াত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে উৎসর্গ করার কথা জানালেন। এরপর বললেন, আমার বাবা ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সখ্য ছিল। সে জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী প্রয়াত সুচিত্রা মিত্রকে নিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটি এ্যালবাম আমি করেছিলাম। তিনি গেয়েছিলেন, আমি বাজিয়েছিলাম। সেই উৎসাহে আজ রাগ খাম্বাজ পরিবেশন করব। কারণ, রবীন্দ্রনাথের বেশকিছু গান ছিল খাম্বাজ রাগে বাঁধা। সবশেষে পরিবেশন করব ভৈরবী। এরপর পুরো আর্মি স্টেডিয়ামে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে সরোদের তারে টোকা দিলেন সরোদসম্রাট আমজাদ আলী খাঁ। তাঁর বাঁ পাশে বসলেন পাখোয়াজশিল্পী ফতেহ সিং গাংগানি, ডানে তবলাশিল্পী সত্যজিৎ তালওয়ালকর। শিল্পী আলাপে বেশি সময় নিলেন না। সংক্ষিপ্ত আলাপ শেষে চলে গেলেন গৎ-এ। সেখানে গিয়ে বিশেষ কোন তালে আটকে থাকলেন না। ঘন ঘন তাল পরিবর্তন করে শোনালেন খাম্বাজের বিভিন্ন প্রকার। এমনকি শোনালেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। মাঝে রাগ যোগিয়া হয়ে ভাটিয়ালির সুরেও ঘুরে বেড়ালেন কিছুক্ষণ। সবশেষে পরিবেশন করলেন ভৈরবী। ভৈরবীর সুর যখন শেষ হলো, তখন হেমন্তের নরম কুয়াশায় ভর করে ভোর নেমেছে। দেহ-মনে সুরের মায়া মেখে ঘরে ফিরলেন হাজার হাজার দর্শক শ্রোতা।
×