ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

হিলারির চৌকস কূটনীতি

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

হিলারির চৌকস কূটনীতি

(১ ডিসেম্বরের পর) হাত তোলা প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবী, বিজ্ঞানী ও সমাজসেবী হতে চাওয়া কয়েকশ’ নতুন প্রাণকে কেবল ক্ষমতার বা শক্তির পাদপীঠ থেকে সবক দেয়ার একপেশে প্রবণতা থেকে সরে এসে এ দেশের মাটির ভিন্নতর পরশ নিয়ে তিনি তারুণ্যকে উজ্জীবিত করেছিলেন এই বলে যেÑ‘এ দেশ অন্য কারও নয়, তোমাদের হাতেই লেখা রয়েছে সোনার বাংলা গড়ার বিশ্বাস ও প্রেরণা। অন্য কারও নয়, তোমাদের হাতেই গড়ে উঠবে সোনার এই বাংলা।’ বের হওয়ার পথে এক ফাঁকে এই সাধারণ্যে উজ্জীবিত সেই প্রথাগত বুলন্দ দরবারের মূলত ক্ষমতা-আশ্রিত কূটনীতিবিদকে বলেছিলাম, এ তো দেখি চৌকস ক্ষমতার কূটনীতিবিদের কথা, এত দিন যা বলেছেন তার চেয়ে ভিন্নতর অনুধাবনের প্রতিফলক। মুচকি হেসে আর কিছু না বলে বিদায় নিয়েছিলেন মজেনা। কাকতালীয় কিনা জানি না, দুদিন পর সংবাদপত্রে দেখলাম তাঁর অনুধাবনও উপলব্ধি; এ দেশের জনগণই ঠিক করবে কখন তাদের পরবর্তী নির্বাচন হবে। হিলারির চৌকস ক্ষমতাভিত্তিক কূটনীতির সবচেয়ে বড় সাফল্য হয়ে দেখা দিয়েছে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা। মিয়ানমারের গত কয়েক দশকের জননিগ্রহমূলক নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র হিলারির পূর্বসূরি কন্ডোলিৎসা রাইসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ের আগ থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এসেছিল। মিয়ানমারের সঙ্গে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপণের কারণে মিয়ানমার চীনের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্রমুখী হবে বলে আশা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী গেইথনার কর্তৃক অনুসৃত মৌল কৌশলীয় ও অর্থনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে চীন ও চীনের প্রভাবাধীন দেশসমূহকে বদ্ধ বলয় থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই চেষ্টা ফলবতী হয়নি। এর বিপরীতে হিলারি তাঁর চৌকস ক্ষমতাভিত্তিক কূটনীতিকে সামনে এনে নিষেধাজ্ঞাদি উঠানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে মিয়ানমারে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও মানব অধিকার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ধাপে ধাপে স্থাপন ও প্রসারণের পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। একই সঙ্গে ক্ষমতার মোড়কে চীনকে মিয়ানমারে অধিকতর প্রভাব বিস্তারের প্রতিকূলে হুঁশিয়ার করে চলেছেন। ফলত মিয়ানমারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসকবৃন্দ তাঁদের আচরণে ক্রমশ পরিবর্তন আনলেন। ২০১০ সালের শেষদিকে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক শাসনের অগ্রপথিক আউং সান সুচি গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেলেন, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন অন্য অধিকাংশ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিলেন, পৃথিবীর জন্য ইন্টারনেট অবমুক্ত করলেন ও অচিরেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পথে এগিয়ে এলেন। ফলত ধাপে ধাপে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর তার আরোপিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞাদি শিথিল করল এবং ২০১১ সালের শেষদিকে হিলারি মিয়ানমারে গিয়ে অংসান সুচি ও স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট থেইনের সঙ্গে দেখা করলেন। প্রায় ৫০ বছর পরে যুক্তরাষ্ট্রের কোন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সেটাই হলো প্রথম মিয়ানমার সফর। এরপর চীনের অসন্তোষ সত্ত্বেও সুচি ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে কংগ্রেসের স্বর্ণপদক গ্রহণ করলেন এবং মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রসারের লক্ষ্যে মিয়ানমারের ওপর আরোপিত অবশিষ্ট অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানালেন। তারপর ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি একসঙ্গে মিয়ানমার সফর করলেন এবং ফলত মিয়ানমার স্বৈরতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তির পথে অনেকটা এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পেতে সক্ষম হলো। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সড়ক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা মিয়ানমারের অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদাদি আহরণে প্রযুক্ত হওয়ার অবকাশ পেল। মিয়ানমারের এই পরিবর্তন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের একক প্রতিপত্তির বলয়ের বাইরে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের স্বকীয়তায় এগিয়ে যাওয়ার পথে সহায়ক হয়ে দাঁড়াল। এভাবে গণতান্ত্রিকতা ও মুক্তবাণিজ্যের পথে মুক্তি পাওয়া মিয়ানমারকে বাংলাদেশের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুনভাবে পর্যালোচনা ও উন্নয়ন করার দিক-নিশানা দিয়েছে বলা চলে। এতকাল পর্যন্ত যে স্থবির সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান ছিল তা দূর করে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সফল রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতাবিহীন বন্ধুসুলভ সম্পর্ক জোরদারকরণের লক্ষ্যে আমরাও হিলারি প্রদর্শিত চৌকস কূটনীতি প্রয়োগ করতে পারি। এক. বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা নির্দেশক নাফ নদীর মধ্যস্রোতকেন্দ্রিক যে ৩৫ মাইলের মতো সীমানা এখনও স্থিরিকৃত হয়নি, তা দ্বিপাক্ষিক জরিপের মাধ্যমে স্থিরি ও চিহ্নিতকরণ গুরুত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করা যায়। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে যে আলোচনা হয়েছে তার আলোকে বলা চলে যে এই কাজটি অচিরেই সম্পন্ন করা সম্ভব। দুই. নাফ নদীর উজানে এখনও দৃশ্যত দুর্গম সীমান্ত ধরে বাংলাদেশ ভারতের মতো সীমান্ত হাট স্থাপন করা দুই দেশের স্বার্থানুকূল হবে। এ সব বাণিজ্য-মাধ্যম দিয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যাদি মিয়ানমারে নতুন ও লাভজনক বাজার খুঁজে পাবে এবং মিয়ানমারের কঠিন শিলা, হস্তশিল্পজাত পণ্য ও কাঠ জাতীয় দ্রব্যাদি, রুবী ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজ দ্রব্যাদি বাংলাদেশে রফতানি হতে পারবে। উল্লেখ্য, এ সব খনিজ দ্রব্যের অন্যতম বৃহৎ উৎপাদক দেশ হিসেবে মিয়ানমার স্বীকৃত। এ ধরনের বাণিজ্য রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক দুই দেশের সীমান্ত এলাকার জনগণের জন্মস্থান বিষয়ক বিরোধ কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। তিন. নাফ নদীর মৎস্য সম্পদ আহরণ ও উন্নয়ন, নদী সংরক্ষণ ও পরিবহন সমন্বয়করণ এবং এই উদ্দেশ্যে নদীকেন্দ্রিক সকল কার্যাদি ও প্রকল্পাদি নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন করার লক্ষ্যে নাফ নদী উন্নয়ন কমিশন নামে দুই দেশের সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে একটি দ্বিপাক্ষিক সংগঠন স্থাপন করা লক্ষ্যানুগ হবে। উল্লেখ্য, যথাযথ আহরণ ব্যবস্থার আওতায় দুই দেশের জেলেরা বর্তমানে যেভাবে ও সময়ে নাফ নদীর মাছ আহরণ করছে তা এই সম্পদ কমিয়ে দেয়ার আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এ দুই দেশের সমন্বিত কার্যক্রমের আওতায় এ আশঙ্কা দূর করতে হবে। চার. বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে উপকূলীয় সমুদ্র বাণিজ্যের প্রসার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে লাভজনকভাবে কাঠ, সিমেন্ট, ক্লিংকার, চুনাপাথর, তেল ইত্যাদি আমদানি করতে পারে এবং বিনিময়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত ভোগ্যপণ্যাদি রফতানি করতে পারে। ফলত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও টেকনাফের সঙ্গে মিয়ানমারের হাকা, সিত্ত-ওই, নাইপাইতাও, মান্দালয় ও ইয়াংগুনের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিস্তৃত হতে পারে। পাঁচ. দুই দেশের জনগণের মধ্যে যাতায়াত ও যোগাযোগ উন্নতর এবং বিস্তৃত করে বাংলাদেশ গণতন্ত্রায়নে, বিশেষত মিয়ানমারের আকিয়াব (শহর) ও ইরাবতী নদীর পশ্চিমাঞ্চলের মিয়ানমারের নাগরিকদিগকে একই দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের সমাধিকার লাভ ও সংরক্ষণে গণতান্ত্রিক পৃথিবীর চেতনা সৃষ্টি ও সমর্থনের জানালা হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ মিয়ানমারকে পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণ, ভূমি জরিপ ও প্রশাসন এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা প্রসারণে প্রশিক্ষণ সহায়তা দিতে পারবে। একই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নততর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানাদিতে মিয়ানমারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কতিপয় আসন সংরক্ষণ করা এবং সে লক্ষ্যে বৃত্তি প্রদান কর্মানুগ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মিয়ানমার উন্মুক্তকরণের মধ্য দিয়ে তাঁর সময়ে লিবিয়ার বেনগাজিতে ঘটিত কূটনৈতিক সহিংসতা সত্ত্বেও হিলারি মোটা দাগে সফলতার স্বীকৃতি পেয়েছেন। চৌকস ক্ষমতার বলে কূটনীতিকে বস্তুমুখীকরণে যে সফলতা হিলারি দেখিয়েছেন, তাঁর স্বীকৃতি সম্ভবত ঘটতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্র্বাচনে। যদিও এখন পর্যন্ত হিলারি ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দল থেকে প্রার্থী হবেন কিনা, তা আনুষ্ঠানিকভাবে বলেননি, তথাপিও ২০১৪ সালের এই হেমন্তের লাল হলুদের লীলাভূমি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সুশীল সমাজের আলোচনা থেকে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, হিলারি এগোবেন এবং ২০১৬ সালে আসবেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। তাঁকে হারানোর জন্য সামর্থ্য নিয়ে তেমন কোন রিপাবলিকান প্রার্থী এখনও রাজনীতির দৃশ্যপটে দেখা দেননি। এভাবে এগিয়ে এসে শতাব্দীর আভিজাত্যের একপেশে কঠিন বুলান্দ দরবার থেকে হিলারি কূটনীতিকে অধিকতর মুক্তি দেবেন সকল দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংবেদনশীল বহুমাত্রিক চৌকস কার্যক্রম হিসেবে আশা করা হয়। (সমাপ্ত)
×