ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব দরবারে দেশের পরিচিতি আরও বাড়বে

বিশেষ চুল্লীতে পোড়ামাটির প্রতœ রেপ্লিকা তৈরি হলো বগুড়ার গ্রামে

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

বিশেষ চুল্লীতে পোড়ামাটির প্রতœ রেপ্লিকা তৈরি হলো বগুড়ার গ্রামে

সমুদ্র হক ॥ কুমোরবাড়ির বিশেষ ধরনের চুল্লীতে প্রাচীন ইতিহাসের পোড়া মাটির নক্সার (টেরাকোটা) অসাধারণ অনুকৃতি (রেপ্লিকা) শেষ পর্যন্ত তৈরি করা গেল বগুড়ার নিভৃত গ্রাম শেখেরকোলার পালপাড়ায়। একটানা ১৮ ঘণ্টা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় প্রায় ৫শ’ রেপ্লিকা পুড়িয়ে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে এগারোটায় চুল্লী খুলে বের করে আনা হয় দেশে এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি রেপ্লিকা। এর আগে দেড় মাস ধরে কাদামাটি দিয়ে বানানো হয় রেপ্লিকা। কুমোররা তো মহা খুশি। বেশি খুশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। যার উদ্যোগে ও নেতৃত্বে ইতিহাসের চুল্লীতে এগুলো তৈরি হলো। অনুভূতি ব্যক্ত করলেন এভাবে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশই তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নানা মাধ্যমে তুলে ধরে। বাংলাদেশও কেন পিছিয়ে পড়বে! এই ভাবনায় ইতিহাসের পথ ধরেই বাংলার মৃৎশিল্পীদের (কুমোর) বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে প্লাস্টার অব প্যারিসে ডাইস ও কনস্ট্যান্ট টেম্পারেচার রাখার বিশেষ ধরনের চুল্লী বানিয়ে তৈরি করা হয় রেপ্লিকা। তার মতে প্রাচীন আমলে এই কুমোররাই টেরাকোটা বানাত। সেই বাংলার কুমোররাই রেপ্লিকা বানিয়ে প্রমাণ করল হিস্টরি রিপিট ইটসেলফ (ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে)। টেরাকোটার প্রথম রেপ্লিকা অবমুক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা। তিনি বললেন, বাংলাদেশে পর্যটক আকর্ষণে প্রতœ সম্পদের বিশাল ভা-ার রয়েছে। পর্যটকরা এসে ভ্রমণ শেষে এই রেপ্লিকা নিজেদের দেশে নিয়ে গেলে বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি আরও বাড়বে। বগুড়ার মহাস্থানগড় এবং নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বর খনন করে প্রমাণ মিলেছে বাঙালীর ইতিহাস আড়াই হাজার বছরের। কালের বহু প্রতœনিদর্শন মাটির উপরিভাগে ও নিচে লুকিয়ে আছে। যা উন্মোচিত হচ্ছে। মহাস্থানগড়, ভাসু বিহার পাহাড়পুর কান্তজীর মন্দিরসহ বিভিন্ন জায়গায় যে সব টেরাকোটা আছে তার প্রতিকৃতি (ছবি) তুলে এনে শিল্পীদের দেখিয়ে রেপ্লিকা বানিয়ে মানুষের হাতে তুলে দিতে পারলে ইতিহাসের পথকেই এগিয়ে নেয়া হবে। ঐতিহ্যের বিশাল ভা-ারের গভীরতা বিশ্বকে জানাতে রেপ্লিকা বানোনো বড় উদ্যোগ। নাহিদ সুলতানা জানালেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে মহাস্থানগড়ে পর্যটকদের সামনে এই রেপ্লিকা প্রদর্শন ও বিক্রির উদ্যোগ নেবেন। সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানলেন রেপ্লিকা বানান ছিল পরীক্ষামূলক। এই কাজকে আরও সম্প্রসারিত করে তৈরি রেপ্লিকা ঢাকাসহ দেশের বড় শহরের ডিপার্টমেন্ট স্টোর এবং প্রতœ ও পর্যটন সাইটে বিপণনের চেষ্টা করা হবে। একজন সিনিয়র সাংবাদিক বললেন বাঙালীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান পার্বণে স্বজন, কাছের বন্ধু, অভ্যর্থনা, ফেয়ারওয়েলে এমন কি হৃদয়ের মানুষকেও রেপ্লিকা উপহার দেয়ার প্রবণতা শুরু করা যায়। প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তির রাজধানী পুন্ড্রনগর মহাস্থানগড়ের কাছেই শেখেরকোলা পালপাড়া গ্রামের যে কুমোররা বগুড়ার দইয়ের সরা ও খুঁটি বানাত তাদেরই প্রশিক্ষণ দিয়ে বানান হচ্ছে রেপ্লিকা। অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ‘ঐতিহ্য অšে¦ষণ’ (আরকিওলজি রিসার্চ সেন্টারে) নামের প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে এই কাজ শুরু হয় বগুড়ায়। যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তাঁরাই পরবর্তীতে প্রতœ এলাকায় গিয়ে রেপ্লিকা বানানো শেখাবেন। বাঙালীর ইতিহাস, প্রাণী জগত, উদ্ভিদ জগতের পরিচয়সহ সেদিনের প্রকৃতির সবই টেরাকোটায় অঙ্কিত আছে। কান্তজীর মন্দিরের সারে বাইশ হাজারেরও বেশি টেরাকোটা এতটাই সমৃদ্ধ যে ওই সময়ের বাঙালী জাতির প্রাত্যহিক জীবনের সকল কিছুই মৃৎশিল্পের কারুকার্যে তুলে ধরা হয়েছে। রেপ্লিকা তৈরির ধারাবাহিকতা এ রকম- প্রথমে টেরাকোটার একটি রঙিন ছবি তুলে তা কম্পিউটারে স্ক্যান করে নেয়া হয়। এসব ছবি অন্তত দশটি এ্যাঙ্গেলে তুলে মৃৎশিল্পীদের দেখানো হয়। প্লাস্টার অব প্যারিসে ডাইস বানানো হয়। এই ডাইসেই (ছাঁচ) আঠাল মাটি ভরে চারদিকে সাইজ করে প্রথমে রোদে শুকানোর পর চুল্লীতে পোড়ানো হয়। বিশেষ ধরনের এই চুল্লীতে তুষ ও কাঠের আগুনে রেপ্লিকা পোড়ানো হয়। রেপ্লিকা বানানোর এই কাজে সহযোগিতা দিচ্ছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (বিপিসি), প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ও এশীয় ব্যাংক। বগুড়ার গ্রামে রেপ্লিকা বানানোর পর আশপাশের এলাকাতেও সাড়া পড়ে গেছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা টেরাকোটায় যে ভাবে সমৃদ্ধ করা হয়েছে রেপ্লিকাতেও সেভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
×