ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার রাস্তায় গুগল বাস- উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

ঢাকার রাস্তায় গুগল বাস- উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন

ফিরোজ মান্না ॥ ঢাকার রাস্তায় গুগল বাস। ইতিবাচক-নেতিবাচক নানা আলোচনা। গুগল কি সত্যিই দেশের শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ব্যবহার শেখাতে গুগল বাস নামিয়েছে। নাকি এর পেছনে অন্য কিছু। বিজ্ঞাপন ও তাদের পণ্য বিক্রির হিসাবটি সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগল এখন তথ্যপ্রযুক্তির নানা পণ্যও বিক্রি করছে। বিশ্বব্যাপী তাদের ‘মনোপলি’ ব্যবসা। তথ্যপ্রযুক্তির সব শাখাতেই তারা এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গুগলের এমন অবস্থার মধ্যে গত ৪ বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বিভিন্ন অভিযোগে গুগলের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। গুগলের বিরুদ্ধে কেন তদন্ত করছে ইইউ। চীনে গুগলের কার্যক্রম আইনকানুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমন প্রশ্ন থেকেও বাংলাদেশে তাদের বাস সার্ভিসটি নিয়েও আলোচনা চলছে। তথ্য প্রযুক্তিবিদরা মনে করছেন, এটা তাঁদের ব্যবসা বাড়ানোর কৌশল। বিশ্বের দেশে দেশে গুগল তাদের প্রচার কাজ এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা বলেছেন, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে গুগলের অফিস থাকলেও পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারে তাদের কোন অফিস নেই। ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে গুগলের বাস ইন্টারনেট নিয়ে কাজ করেছে। ওই সব দেশে গুগল তাদের প্রচারের জন্য গুগল বাস নামের বাসসহ নানাভাবে বাজার ধরেছে। ভারতে ২০০৯ সাল থেকে বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। ২০১২ সালের ৫ নবেম্বর গুগল বাংলাদেশে গুগল অফিস খোলে। গত ১১ নবেম্বর ঢাকার রাস্তায় গুগল বাস নামে। বাংলাদেশেও তাদের প্রচার কাজের জন্যই বাসটি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাবে। ঢাকায় গুগল অফিস জানিয়েছে, গুগল শুরুতে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছে। আর এই ইঞ্জিনের ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতার কাজও চালিয়ে গেছে। বাংলাদেশেও তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়েই কাজ করতে এসেছেন। সূত্র জানিয়েছে, গুগলের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) এ্যান্টিট্রাস্ট কমিশন টানা ৪ বছর ধরে তদন্ত করছে। এই ৪ বছরে কোন সন্তোষজনক ফলাফল আসেনি। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন প্রস্তাব উত্থাপনের ঘটনা এটাই প্রথম। এ্যান্টিট্রাস্ট কমিশনের এক প্রতিবেদন নিয়ে ইতোমধ্যে বিবিসি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইইউ বনাম গুগল দ্বন্দ্ব যে কতটা ‘সাংঘাতিক’ পর্যায়ে পৌঁছেছে সেটাই প্রমাণ করছে ইউরোপীয় পার্লামেন্টর এই ভোটাভুটির মাধ্যমে। গুগলের বিরুদ্ধে সার্চ ব্যবস্থায় শুধু নিজেদের পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া, অনুমতি ছাড়াই অন্যান্য সাইটের তথ্য গুগল সার্চে ব্যবহার করা আর বিজ্ঞাপনদাতাদের অন্য কোন সাইটে বিজ্ঞাপন প্রচারে বাধা দেয়ার মতো অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতেই অনুসন্ধান করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে গুগল তাদের সার্চ সেবায় পরিবর্তন আনলেও তা অভিযোগকারীদের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। পরে তারা নতুনভাবে অভিযোগ গঠনের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার জনকণ্ঠকে বালেন, গুগল যে কাজটি করছে, সেটা তাদের প্রচারের জন্যই করছে। বাংলাদেশকেও তারা বড় বাজার হিসেবে দেখছে। এ জন্য বাংলা ভাষায় তারা সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করেছে। এই সার্চ ইঞ্জিন যাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ ব্যবহার করে সে জন্য তারা ‘গুগল বাস’ নামের একটি সার্ভিস চালু করেছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা রাস্তায় ওই বাস ঘুরলে গুগলের একটা বড় ধরনের বিজ্ঞাপন হচ্ছে। গুগল সার্চ ইঞ্জিন যত বেশি ব্যবহার হবে- বিজ্ঞাপনের হার তত বেশি বাড়বে। আমার মনে হয় না এখানে তাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। তবে ১৬ কোটি মানুষের দেশে একটি মাত্র বাস দিয়ে তারা কতটুকু ইন্টারনেট শেখাতে পারবে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। দেশে বর্তমানে ৪ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এখন মোবাইল ব্রডব্যান্ডসহ নানা মাধ্যম থেকেই মানুষ ইন্টারনেটের ব্যবহার শিখছেন। গুগল বাস দেশের কয়টা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবে। দেশে তো হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আসলে এটা তাদের বিজ্ঞাপনী প্রচার। ইউরোপে গুগলের বিষয়ে এখন নানা আলোচনা হচ্ছে। তারা শুধু সার্চ ইঞ্জিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। গুগলের রয়েছে নানা পণ্য। একবার গুগলের মধ্যে ঢুকে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া মুশকিল। এ কারণেই গুগল নিয়ে তারা নানা প্রশ্ন তুলেছে। বাংলাদেশ এ্যাসেসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সাবেক সভাপতি ও তথ্য প্রযুক্তিবিদ হাবিবুল্লাহ এন করিম জনকণ্ঠকে বলেন, গুগল বাংলাদেশে মূলত যে কাজটি করছে তা হচ্ছে, ‘টেকনোলজিক্যাল ইকো সিস্টেম ডেভেলপ’ করা। সেই কারণেই তারা গুগল বাস নামের একটি বাস বাংলাদেশে এনেছে। এই কাজটি তারা ভারতে, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরেও করেছে। সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগল বিশ্বের এক নম্বর স্থান দখল করে আছে। তারা একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। বিশ্বে যত বিজ্ঞাপন হচ্ছে তার বিরাট একটি অংশ গুগল পাচ্ছে। বাংলাদেশেও এমন একটি বাজার তৈরির সম্ভাবনা থেকে তারা এখানে অফিস থেকে শুরু করে নানা কাজই করে যাচ্ছে। পণ্যের দিকটিও তারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইট ইউটিউব ও ই-মেইল আদান-প্রদান সেবা দিচ্ছে। কিছু সেবা তাদের বিনা পয়সায় হলেও বেশিরভাগ সেবাই পয়সার বিনিময়ে দিচ্ছে। গুগলের আয়ের একটি অংশ আসে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে সার্চ টেকনোলজি বিক্রির মাধ্যমে। বাংলাদেশেও তারা যে সব ওয়েবসাইট র‌্যাঙ্কিংয়ের দিক থেকে ওপরের দিকে তাদেরও সঙ্গে চুক্তি করে নিজেরাও লাভবান হচ্ছেÑ আবার ওই ওয়েবসাইটগুলো বড় অঙ্কের টাকা পাচ্ছে। বাংলাদেশে তাদের বেশ ক’টি ওয়েবসাইটের সঙ্গে চুক্তি আছে- এর মধ্যে রয়েছে প্রথম আলো, ফুড পান্ডা, বিডি জবস, বিক্রয় ডটকমসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। গুগল বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করায় এ দেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট আপসের বাজার গুগলই নিয়ন্ত্রণ করছে। অল্প দিনের মধ্যে বিশ্বে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১২ কোটি মানুষ মোবাইল ব্যবহার করছে। আন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমসহ মোবাইল ফোন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসায় অনেক বেশি মনোযোগী হয়েছে গুগল। মোটকথা গুগল এখন এমন একটি অবস্থানে চলে গেছেÑ গুগলে যুক্ত হলে আর কোন সার্চ ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এ জন্যই ইউরোপীয় ইউনিয়ন গুগল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাছাড়া যদি কোন প্রতিষ্ঠান এককভাবে ব্যবসা করে- ওই প্রতিষ্ঠানকে ভেঙ্গে দেয়ার একটা সংস্কৃতি বহু আগে থেকেই চলে আসছে। ইউরোপ এটা চাচ্ছে। চায়নাতে গুগলের অফিস থাকলেও সেখানে তাদের চলতে হচ্ছে অনেক আইনকানুন মেনে। চীনে ‘বাইডু’ নামের তাদের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন রয়েছে। এই সার্চ ইঞ্জিন দিয়েই চীনারা ইন্টারনেটসহ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করছে। বর্তমানে বিশ্বের ৪৯টি দেশে বিশেষায়িত সেবা ও পণ্য বিক্রি করছে গুগল। বাংলাদেশে গুগলের অফিস খোলার পর কান্ট্রি কনসালটেন্ট কাজী মনিরুল কবিরকে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি এর আগে বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বাংলালিংক ও রহিমআফরোজসহ বেশ ক’টি কোম্পানিতে কাজ করেছেন। দুই বছরের মাথায় কাজী মনিরুল কবির গুগল ছেড়ে দিয়েছেন। গত ১ সেপ্টেম্বর তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কানাডায় চলে যান। তার জায়গায় আর কাউকে নিয়োগ করা হয়নি। বর্তমানে গুগলের ঢাকা অফিসে সানা রহমান নামের একজন প্রতিনিধি রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছেন কোন কিছু জানতে হলে গুগল হেড কোয়ার্টারে ই-মেইল করে জানতে হবে। তবে বাংলাদেশে যে বাসটি কাজ করছে সে বিষয়ে গুগলের ঢাকা অফিস থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। গুগলের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে বাসটি এক বছর বাংলাদেশে এসেছে। বাসটি দেশের ৩৫টি এলাকায় ৫শ’ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেবে। এই বাস থেকেই ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করে শিক্ষার্থীরা নিজের চেষ্টায় তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট বিষয়ে বিভিন্ন কলাকৌশল জানতে পারেন এই বাসের মাধ্যমে। স্মার্টফোন ও ট্যাবলেট কম্পিউটার ব্যবহার করে গুগল প্লাস, গুগল ড্রাইভ, গুগল কমিউনিটিস এবং গুগল হ্যাংআউটসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাওয়া যাবে এই বাসের মাধ্যমে। সূত্র জানিয়েছে, গুগল বাস কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গুগল বিভিন্ন প্রযুক্তি সেবা দেবে। এই বাস থেকে শিক্ষার্থীরা গুগল টুলস ও ইন্টারনেট বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ পাবেন। এই বাস বা স্ট্রিট ভিউ প্রজেক্ট ঢাকার বাইরে সকল বিভাগীয় শহরসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও পর্যটন এলাকায় যাবে। গুগল আউটরিচ প্রোগ্রাম ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে সব শহরে উদ্যোক্তা এবং ডেভেলপার পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া হবে। কলেজ ও ইউনিভার্সিটির ৬ লাখেরও বেশি ছাত্রছাত্রীকে গুগল অ্যাপসের ওপর প্রশিক্ষণ পাবেন, যা দেশের জন্য একটি বড় কাজ বলে মনে করছেন তথ্য প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন। গুগল বাসের উদ্বোধন করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এতে গুগলের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ প্রকল্পের বাসটি উদ্বোধন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানেই গুগলের পক্ষ থেকে বলা হয় প্রয়োজনে এমন একাধিক বাস বাংলাদেশে তারা চালু করবে।
×