ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিজয়ের মাস

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

বিজয়ের মাস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিজয়ের তেতাল্লিশ বছর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এ বিজয় শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ও মহান আত্মত্যাগ। মুক্তিপাগল বাঙালী জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে আনে হাজারো বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বছর ঘুরে আবার এসেছে সেই বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি ও ভূখ-ের স্বীকৃতি আদায়ের মাস। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল সন্তানদের ছিনিয়ে আনা বীরত্বগাথা বিজয় অর্জনের মাস। বাংলার ঘরে ঘরে স্বাধীনতাবিরোধীদের সকল চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র মোকাবেলার দীপ্ত শপথের মধ্য দিয়ে সোমবার সূচিত হয়েছে বিজয়ের মাসের মাসব্যাপী কর্মসূচীর। ৪৩ বছর আগের ২ ডিসেম্বর। একাত্তরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর যতই এগিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যেন ততই এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় মেতে ওঠে হিংস্র পাক হানাদার বাহিনী। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহের দিকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী তার রাজাকার, আলবদর ও সেনাবাহিনীকে দেশের চারদিকে ছড়িয়ে দেয় নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালাতে। কিন্তু তখনও হানাদার বাহিনী বুঝতে পারেনি তাদের পতন অত্যাসন্ন। একাত্তরের রক্তক্ষরা এইদিনে গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখ যুদ্ধের গতি বাড়ে। অপ্রতিরোধ্য বাঙালীর বিজয়রথে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে। পরাজয়ের আভাস পেয়ে তৎকালীন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন মরিয়া হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি চিঠি পাঠান। ইয়াহিয়া তাঁর চিঠিতে যুদ্ধকালীন সাহায্যের আশায় ১৯৫৯ সালের পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির এক অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। সীমান্ত এলাকায় পাক জান্তারা সমরসজ্জা বৃদ্ধি করায় ভারতও তা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ত্রিমুখী যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। এসব দেখেশুনে ভারত সরকার বুঝেছিল, পাকিস্তান যুদ্ধ করবেই। ভারত তখন যে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা বা আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে তা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে ভারত সামরিক প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমের প্রস্তুতি দেখে এবং নাশকতামূলক কাজের লোক ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত মোটামুটি পরিষ্কার বুঝে ফেলে পাকিস্তান রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবে না, বরং লড়াই করবে। তাই তখন থেকে ভারতের প্রস্তুতিও জোরদার হয়েছিল। অন্যদিকে বীর বাঙালীর গেরিলা আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে পাক হানাদররা। যতই সময় গড়াচ্ছিল গেরিলা আক্রমণ ততই প্রবল হতে থাকে। পাক সেন্যদের হাতে তখনও আধুনিক অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকিদের পরাস্ত করতে থাকে। মুক্তিপাগল বাঙালীর অকুতোভয় লড়াইয়ে পাক হানাদারদের রাতে চলাফেরাও কঠিন হয়ে পড়ে। নিয়াজী বুঝতে পারে, এবার বড় ধরনের কিছু করতে না পারলেই নয়। তাই মার্কিন সাহায্য নিশ্চিত, নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি, রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ এ দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে নিয়ে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালানোর জঘন্য পরিকল্পনা আঁটতে থাকে কসাই নিয়াজী। নানা আয়োজনে বিজয় উৎসব শুরু বর্ণাঢ্য ও ব্যাপক আয়োজনে সোমবার পহেলা ডিসেম্বর থেকে মাসব্যাপী বিজয় উৎসব কর্মসূচী পালন শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে দিনটি সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবেও উদযাপিত হয়েছে। বিজয়ের মাসের প্রথম দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা দল ও সংগঠনগুলো রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রথম প্রহরে প্রদীপ প্রজ্বলন, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সমাবেশ ও আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মাসব্যাপী কর্মসূচীও শুরু হয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর রবিবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে প্রদীপ প্রজ্বলন ও আলোর মিছিলের মাধ্যমে কর্মসূচীর সূচনা করে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ। আলোর মিছিল শেষে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ এমপির নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ৩২ নম্বর ধানম-ির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতেও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মুক্তিযোদ্ধা দিবস উপলক্ষে দিনভর নানা অনুষ্ঠান পালন করেন একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন একাত্তরের বীর শহীদদের। সোমবার বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে মাসব্যাপী কর্মসূচী শুরু করেছে বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ। জিয়া ছিলেন পাকিস্তানের গুপ্তচর- বঙ্গবন্ধু পরিষদ ॥ বঙ্গবন্ধু পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তরা বিএনপি-জামায়াত জোটের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, ৭১’র পরাজিত শক্তিরা আজ আবারও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। জিয়াউর রহমান যেমন পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, একইভাবে খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর জন্য গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছেন। তাই আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তরা এ আহবান জানান। মহান বিজয়ের মাস বরণ উপলক্ষে ‘বাঙালী জাতিসত্তা-স্বাধীনতা’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ এস এ মালেকের সভাপতিত্বে সভায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতা অধ্যাপক ড. আকতারুজ্জামান, সাংবাদিক শফিকুর রহমান, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা এ্যাডভোকেট আব্দুস ছালাম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এস এ মালেক বলেন, বঙ্গবন্ধু, বাঙালী জাতিসত্তা ও স্বাধীনতা এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করা যায় না, ঠিক তেমনি তাঁর অবিচল সাহসিকতা ও নেতৃত্বে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। ৭১’র সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক ও সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। তিনি বলেন, মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হলেও তিনি মনে-প্রাণে বাঙালী ও বাঙালিত্বে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মূলত পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রী বেগম জিয়াও পাকিস্তানের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছেন। তিনি এখনও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের প্রদেশ বানাতে চান। বর্তমান সময়ে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য থেকেই তা প্রমাণিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের দাবি ॥ বিজয়ের মাসের সূচনা দিনে আলোচনা সভা করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া এবং মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছে সম্মিলিত ইসলামী গবেষণা পরিষদ। বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানী তরিকা অধ্যায়ের রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ হাফেজ মাওলানা আবদুস সাত্তার।
×