ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জিম্বাবুইয়ে টেস্ট ও ওয়ানডেতে ॥ ডাবল বাংলাওয়াশ

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

জিম্বাবুইয়ে টেস্ট ও ওয়ানডেতে ॥ ডাবল বাংলাওয়াশ

মিথুন আশরাফ ॥ ‘কষ্ট নেবে কষ্ট/হরেক রকম কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট/লাল কষ্ট/নীল কষ্ট...।’ আর কত কষ্ট নেবে জিম্বাবুইয়ে। পুরো সিরিজজুড়েইতো কষ্টের জ্বালাতে পুড়ছে। টেস্টে বাংলাওয়াশ হওয়ার কষ্ট। এরপর আবার ওয়ানডেতেও একই পরিণতির কষ্ট। সেই সঙ্গে টানা ৮ ম্যাচে হারের কষ্টতো আছেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন টেস্টের শিরোপা মুশফিকের হাতে তুলে দিচ্ছেন তখনও কষ্ট। আবার যখন মাশরাফির হাতে ওয়ানডের শিরোপা তুলে দিচ্ছেন তখন যেন জিম্বাবুইয়ানদের কষ্টের সীমা নেই। মাত্রই ৫ উইকেটে হেরে বাংলাওয়াশ হওয়ার কষ্ট যে তরতাজা! প্রধানমন্ত্রীকে মাঝখানে রেখে যখন ডানপাশে মুশফিক ও বামপাশে মাশরাফি শিরোপা তুলে ধরেছেন, তখনতো জিম্বাবুইয়ে ক্রিকেটাররা মাথানতই করে রাখলেন। টেস্টে টানা তিনটি, ওয়ানডেতে টানা পাঁচটি হারের সম্মুখীন বাংলাদেশের কাছে যে আর কোনদিনই হয়নি জিম্বাবুইয়ে। এমন কষ্ট কী আর ভুলে যাওয়ার। চতুর্থ ওয়ানডেতে তাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়েছে জিম্বাবুইয়ে। পঞ্চম ও শেষ ওয়ানডেতে গিয়েতো বাংলাদেশের কাছে পাত্তাই পেল না। তাইজুল ইসলাম কী ঘূর্ণির জাদুই না দেখালেন। অভিষেক ওয়ানডেতেই হ্যাটট্রিক করে বিশ্বরেকর্ড গড়লেন। সব মিলিয়ে নিলেন ৪ উইকেট। তাঁর এমন বোলিংয়ে জিম্বাবুইয়ে ৩০ ওভারে ১২৮ রান করতেই অলআউট হয়ে গেল। যেখানে প্রথম ইনিংস শেষ হওয়ার কথা ৫০ ওভারে, সেখানে পুরো ম্যাচই শেষ হয়ে গেল ৫৪.৩ ওভারে! খেলার ৪৫.৩ ওভার বাকি থাকতেই ম্যাচ শেষ। ২৪.৩ ওভারেই ৫ উইকেট হারিয়ে ১৩০ রান করে ম্যাচ জিতে নিল বাংলাদেশ। সোলোমন মিরের বলে মিড উইকেট দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ক্যারিয়ারের ১২তম অর্ধশতক পূরণ করার সঙ্গে অপরাজিত ৫১ রান করে বাংলাদেশকে ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছাড়লেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তাঁর সঙ্গে সাব্বির রহমান রুম্মনও (১৩*) হাতে হাত মিলিয়ে মাঠ ছাড়লেন। এমন জয় বাংলাদেশ কোনদিনই পায়নি। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে কোন প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার পর পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও হোয়াইটওয়াশের স্বপ্নের সমাধী কোনদিনই দেখেনি। এবার জিম্বাবুইয়েকে ভালভাবেই ধোলাই দিল বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে একবার জিম্বাবুইয়েকে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। এবার দ্বিতীয়বারের মতো সেই স্বাদ নিল। তবে এর আগে ২০০৯ সালে টেস্টে ও ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। নিজ দেশে এই প্রথম এত বড় সিরিজের প্রতিটি ম্যাচই বাংলাদেশের দখলে গেল। অথচ ম্যাচের শুরুতে কিন্তু জিম্বাবুইয়ে যেভাবে খেলছিল, তাতে মনে হয়েছে অঘটন ঘটে যেতে পারে। শেষবেলায় এসে জিম্বাবুইয়ে ম্যাচ জয় পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু ৯৫ রানে যেই মাসাকাদজাকে আউট করে দিলেন জুবায়ের হোসেন, শুরু হয়ে গেল জিম্বাবুইয়ের আবারও ভরাডুবি। ৯৫ রান থেকে শুরু। ১২৮ রানে গিয়েই খতম জিম্বাবুইয়ের ইনিংস। ৩৩ রানে নেই ৯ উইকেট! কী দুর্দশা। তাইজুল এমন দক্ষতাই দেখালেন, তার বলই বুঝতে পারল না জিম্বাবুইয়ে ব্যাটসম্যানরা। ২৬.৬ ওভারে পানিয়াঙ্গারাকে আউট করার পর ২৮.১ ও ২৮.২ ওভারে গিয়ে যথাক্রমে নিয়ুম্বু ও চাতারাকে আউট করে দিয়ে অভিষেক ওয়ানডেতেই হ্যাটট্রিক করে ফেললেন। বিশ্ব ক্রিকেটে এর আগে যে নজির আর নেই। তাইজুলেরটিসহ হ্যাটট্রিকের গৌরবের সংখ্যা ৩৬টি। এর মধ্যে তাইজুলই শুধু অভিষেক ওয়ানডেতে এ কৃতিত্ব গড়েছেন। জিম্বাবুইয়ের ইনিংস শেষ হতেই যেন বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা থাকে কতক্ষণে দল জিতবে। বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামার পর দেখা গেছে তারাও ধসের মধ্যে পড়ে গেছে। ৫৮ রানেই তামিম, এনামুল, অভিষিক্ত সৌম্য সরকার, সাকিবের উইকেটের পতন ঘটে যায়। কিন্তু এরপরও জয়ের ব্যাপারে কারোরই শঙ্কা থাকেনি। উইকেটে যে মাহমুদুল্লাহ-মুশফিক থাকেন। শেষ পর্যন্ত এই দুইজন দলকে ৯৫ রানে নিয়ে যান। এমন সময়ে মুশফিক (১১) আউট হয়ে যান। শেষ পর্যন্ত মাহমুদুল্লাহ-সাব্বির মিলে দলকে জেতান। জিম্বাবুইয়েকে ওয়ানডেতেও হোয়াইটওয়াশ করার স্মৃতি বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাঠও ছাড়েন। এমন উদ্ভাসিত জয় মিলেছে। অথচ ক্রিকেটারদের মধ্যে নেই তেমন উৎসবের আমেজ। আমেজ আসবেইবা কিভাবে, জিম্বাবুইয়েকে হারানো যে এ সিরিজে ‘ডালভাত’ হয়ে গেছে। খেলবে আর বাংলাদেশ জিতবে, নিয়তি যেন এমনটিই হয়ে গেছে। প্রায় দেড় মাস ধরে বাংলাদেশে আছে জিম্বাবুইয়ে। প্রতিটি দিনই তাদের বিধ্বস্ত থেকেই কাটিয়ে দিতে হয়েছে। তবে শেষটা তাদের বিধ্বস্ত হয়নি। হারের কষ্ট আছেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে পরাজিত জিম্বাবুইয়ে দলের সঙ্গেও ছবি তুললেন, তাতে সেই কষ্টে কিছুটা হলেও প্রলেপ পড়ার কথা! জিম্বাবুইয়ে অধিনায়ক এলটন চিগুম্বুরা বললেন, ‘সিরিজটি খুবই হতাশার গেছে। বিশেষ করে বিশ্বকাপের আগে এমন সিরিজ কাম্য নয়। বোলাররা পুরো সিরিজজুড়েই ভাল করেছে। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা সেই কাজ করতে পারেনি। বিশ্বকাপের আগে এখন ভুলগুলো শুধরে নিতে পারলেই হয়।’ বাংলাদেশ সিরিজ শেষ। এ সিরিজে যেমন ধোলাই হয়েছে জিম্বাবুইয়ে, তা ভুলে যেতে পারলেই যেন ভাল হয়। তাইতো এখনই বিশ্বকাপ নিয়েই ভাবতে শুরু করেছেন জিম্বাবুইয়ে অধিনায়ক। বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা যেন শুধু আনন্দের কথাই বলতে চাইলেন। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অধিনায়ক হয়েও ইনজুরির জন্য হোয়াইটওয়াশে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। ২০১০ সালেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একই পরিণতি হয়। এবার তাঁর হাত ধরেই হোয়াইটওয়াশের কৃতিত্ব করে দেখাল বাংলাদেশ। তাই মাশরাফিও বললেন, ‘আমরা খুবই আনন্দিত।’ তবে ম্যাচসেরা তাইজুল ইসলাম কিন্তু খুবই আপ্লুত। এমন একটি ম্যাচ ক্যারিয়ারে যুক্ত হলে কে না আপ্লুত হবেন। একেতো ম্যাচ জেতা হয়েছে। সেই ম্যাচটি আবার প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করার ম্যাচ। সেই ম্যাচে নিজে আবার প্রথমবার ওয়ানডেতে খেলতে নেমেই হ্যাটট্রিক করে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। তাই তাইজুল বলেছেনও, ‘অসাধারণ লাগছে। বিশেষ করে এমন জয়ে অবদান রাখতে পারা যে কোন ক্রিকেটারের জন্যই আনন্দের।’ ৪২.৬০ গড়ে ২১৩ রান করে সিরিজ সেরা হয়েছেন মুশফিকুর রহীম। সিরিজ সেরা হওয়ার আনন্দ না যত, তার চেয়ে বেশি আনন্দিত যেন টেস্টের শিরোপা হাতে পেয়ে হয়েছেন। এ টেস্ট সিরিজ জয় যে বাংলাদেশকে পাল্টেই দিয়েছে। সেই জয়েইতো ওয়ানডে সিরিজ জয়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই মুশফিক বলেছেন, ‘বছরজুড়ে আমরা অনেক কষ্ট করেছি। তার সুফল পেয়েছি।’ বাংলাদেশের এ সুফল জিম্বাবুইয়েকে কষ্টে পুড়িয়েছে। বাংলাদেশ যেন জিম্বাবুইয়েকে পেয়ে বছরজুড়ে হারতে থাকার সব কষ্ট জিম্বাবুইয়ের ঘাড়ে ঢেলে দিতে চেয়েছে। তা করতেও পেরেছে। তাইতো টেস্টের পর ওয়ানডেতেও জিম্বাবুইয়েকে বাংলাওয়াশ করা হয়ে গেছে। প্রথমবার বাংলাদেশ ক্রিকেটে দুই অধিনায়ক প্রথা চালু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও কী ভাগ্য, একসঙ্গে দুই শিরোপা দুই অধিনায়কের হাতেই তুলে দিয়েছেন। দুই শিরোপাই আবার জিম্বাবুইয়েকে বাংলাওয়াশ করার! রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন ॥ টেস্ট সিরিজের পর এক দিনের সিরিজেও জিম্বাবুইয়েক হোয়াইওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। আর এই জয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়েছে বিভিন্ন মহল। সোমবার এক বার্তায় রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘পাঁচ ম্যাচের এক দিনের সিরিজে জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়, কোচ এবং অন্য কর্মকর্তাদের অভিনন্দন। আশা করি, জয়ের এই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতেও ধরে রাখবে টাইগাররা।’ এদিকে প্রধানমন্ত্রী নজিরবিহীন এই সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়, কোচ, ম্যানেজার ও অন্য কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে বাংলাদেশ দল তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখবে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ দলের অব্যাহত সাফল্য কামনা করেন।
×