ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধাপরাধ বিচার

সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায় রিভিউ করা যাবে

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৬ নভেম্বর ২০১৪

সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায় রিভিউ করা যাবে

আরাফাত মুন্না ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-িত যুদ্ধাপরাধীরা সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবেন। তবে এ আবেদন দাখিল করতে তারা সময় পাবেন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকে ১৫ দিন। একই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষও রিভিউ আবেদন করতে পারবে। তবে রিভিউ কখনই আপীলের সমকক্ষ হবে না। এছাড়া এই রিভিউ আবেদন দ্রুততার সঙ্গে শুনানি করে নিষ্পত্তি করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের দ- কার্যকরে জেল কোডের ৭ দিন অথবা ২১ দিনের বিধানও প্রযোজ্য হবে না। তবে মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর দ-প্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাবেন। সুপ্রীমকোর্ট অন্তর্নিহিত ক্ষমতা বলে রিভিউ আবেদনের এই সুযোগ দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসব বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে। মঙ্গলবার সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এর আগে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপীল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এই রায় দেন। প্রায় ১১ মাস পর ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের মাধ্যমে চূড়ান্ত সমাপ্ত হলো রিভিউ বিতর্কের। প্রধান বিচারপতি ছাড়া বেঞ্চের অন্য চার বিচারপতি হলেন- বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এই রায়টি লিখেন আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এসকে সিনহা। প্রধান বিচারপতিসহ অন্য চার বিচারপতি তার লেখা রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। এদিকে কাদের মোল্লার রিভিউ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আলাদাভাবে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপীল বিভাগ রিভিউর সুযোগ রেখেছেন। এখন সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ করার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। অন্যদিকে, খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, কামারুজ্জামানের মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই আমরা রিভিউ আবেদন করব। এই রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে দ-িতদের ক্ষেত্রেও আপীলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন গ্রহণযোগ্য (মেনটেইনেবল) হবে। তবে তা আপীলের সমকক্ষ হবে না। রায়ে বলা হয়, সাধারণ মামলার ক্ষেত্রে রিভিউয়ের জন্য ৩০ দিন সময় দেয়া হলেও এ আইনের মামলায় তা প্রযোজ্য হবে না। ১৯৭৩ সালের এই আইনের অধীনে রিভিউয়ের সময় হবে ১৫ দিন। রায়ে আরও বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-ের রায় আপীল বিভাগ বহাল রাখলে এবং আসামিপক্ষ পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে তার নিষ্পত্তি হওয়ার আগে দ- কার্যকর করা যাবে না। আপীল বিভাগের সর্বোচ্চ সাজার আদেশে বিচারিক আদালত (ট্রাইব্যুনাল) মৃত্যু পরোয়ানা পাঠালে আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন। তবে কারাবিধিতে উল্লেখিত ৭ বা ২১ দিনের সময়সীমা প্রযোজ্য হবে না। ভারতীয় সুপ্রীমকোর্টের একটি রায়ের নজির দেখিয়ে এই রায়ে বলা হয়, আপীলে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের নিকট পুরো প্রক্রিয়া উপস্থাপিত হয়। আইনের সীমায় পুরো দলিলাদির ভিত্তিতে সমগ্র প্রক্রিয়াকে বিবেচনা করা হয়। যদি কোন পক্ষ আদালতের কোন আদেশ বা রায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এক্ষেত্রে রিভিউর সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকলে আদালত অন্তর্নিহিত ক্ষমতাবলে তার রায় বা আদেশ রিভিউ করতে পারেন। আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে কোনো আদালতে, বিচারের যে কোনো পর্যায়ে রিভিউর ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায়। রায়ে বলা হয়, বিচার বিভাগের প্রাথমিক কাজ হলো, পক্ষগুলোর মধ্যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। যাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তবে এটা সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে নয় উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ১৯৭৩ সালের আইনটি একটি সুরক্ষিত আইন। তাই সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। সংবিধানের ৪৭ (ক) (২) অনুসারে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িতদের সংবিধানের আলোকে প্রতিকার চাইতে পারেন না। তারা আপীলের অধিকার পায় ১৯৭৩’র আইনের আলোকে। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে নয়। যদি ১০৩ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য না হয়, তাহলে রিভিউ করার জন্য ১০৪ ও ১০৫ অনুচ্ছেদও প্রযোজ্য হবে না। স্বাভাবিকভাবে সুপ্রীমকোর্ট (আপীল বিভাগ) রুল-১৯৮৮ও প্রযোজ্য হবে না। রায়ে আরো বলা হয়, রিভিউ আপীলের সমকক্ষ নয়। এটা এখন মীমাংসিত বিষয় যে, রিভিউ আবেদনকারীর একটি অধিকার হিসাবে বিবেচিত হবে না। পূর্ববর্তী আদেশের নির্ভরযোগ্যতায় খাদ পাওয়া গেলে বা বিচার-বিভ্রাটের ফল সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে বলে সন্তুষ্ট করতে না পারলে পুনর্বিবেচনা অনুমোদনযোগ্য হবে না। কোনো মামলা রায়ের রিভিউ একটি গুরুতর পদক্ষেপ। চোখে পড়ার মতো কোন কিছু বাদ গেলে বা সুস্পষ্ট বা বড় কোনো ভুল না হলে আদালত তার এই ক্ষমতা ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ক্ষেত্রে সংবিধানের কতিপয় অনুচ্ছেদের অকার্যকরতার কথা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সুপ্রীমকোর্টের রিভিউ ক্ষমতা বাতিল করা হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনের ১১ (৩) ধারারও ব্যাখ্যা দেয়া হয় রায়ে। এতে বলা হয়, এ আইনে স্পষ্টভাবেই বিচার কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি আপীল নিষ্পত্তিতেও সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে, যদিও তা নির্দেশনামূলক। এসব বিধান সমন্বিতভাবে পাঠ করলে বোঝা যায়, আইন প্রণেতাদের উদ্দেশে ছিল ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনে বর্ণিত অপরাধের বিচার যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধে যুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করতে এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণেই এটা ঘটেছে। দেশের মানুষ এই সব ঘৃণিত অপরাধীদের বিচার দেখতে চায়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আপীল বিভাগ রাষ্ট্র্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ উভয়কেই চূড়ান্ত রায় রিভিউ চাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তবে ১৫ দিনের মধ্যে ওই আবেদন দায়ের করতে হবে। এ ছাড়া আবেদনটি দ্রুততার সঙ্গে শুনানি করে নিষ্পত্তির কথাও রায়ে বলেছেন। এ প্রেক্ষাপটে আমৃত্যু কারাদ-প্রাপ্ত সাঈদীর রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রপক্ষ রিভিউ আবেদন করবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পওয়ার পর পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। অন্যদিকে কামারুজ্জামানের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, কামারুজ্জামানের মামলায় আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই রিভিউ আবেদন করা হবে। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হওয়ার পর থেকেই রিভিউ নিয়ে বিতর্কের শুরু হয়। এর পর আরেক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সুপ্রীমকোর্টের রায়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয়ার পরও একই বিতর্ক সামনে আসে। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানকে সুপ্রীমকোর্ট থেকে মৃত্যুদ- দেয়ার পরও সেই একই বিতর্ক নতুন করে শুরু হয়। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপীল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদ- দেন। প্রায় আড়াই মাসেরও বেশি সময় পর ৫ ডিসেম্বর আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ের কপি প্রকাশের পর ৮ ডিসেম্বর সেটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল ওইদিনই কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আদেশটি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। রায়ের কপি হাতে পেয়েই তার ফাঁসি কার্যকর করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এক্ষেত্রে তখন জেল কোড অনুযায়ী রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ২১ দিনের আগে নয় ও ২৮ দিনের পরে নয় যে বিধান রয়েছে তা অনুসরণ না করেই ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের জন্য জেল কোডে প্রদত্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে আসামিপক্ষের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে ১০ ডিসেম্বর রাতে সুপ্রীমকোর্টের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন নিজ বাসভবনে কোর্ট বসিয়ে ফাঁসির আদেশ স্থগিত করেছিলেন। পরদিন কাদের মোল্লার পক্ষে রিভিউ সংক্রান্ত দুটি আবেদন দায়ের করা হয়েছিল আপীল বিভাগে। এর একটি ছিল রিভিউ গ্রহণযোগ্য হবে কি হবে না এবং অন্যটি ছিল তার মূল রিভিউ আবেদন। এই দুই আবেদনেরই শুনানি করে ১২ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি কেবল ঘোষণা দেন যে, বোথ দ্য ক্রিমিনাল রিভিউ পিটিশনস আর ডিসমিসড। রিভিউ আবেদন খারিজের দিন রাতেই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কিন্তু রিভিউ আবেদন কী কারণে খারিজ হয়েছে তা স্পষ্ট করেননি আপীল বিভাগ। মঙ্গলবার চূড়ান্ত রায় প্রকাশের পর এ বিষয়ে সকল প্রশ্নের উত্তরই মিলল।
×