ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কৃষিতে নারীর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আসছে

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৫ নভেম্বর ২০১৪

কৃষিতে নারীর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি  আসছে

সুমি খান ॥ “শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল,পুরুষ চালাল হল/নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল/নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে/ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে!”- কিষানির অবদান এভাবেই উঠে এসেছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়।একইভাবে কৃষিখাতে বীজ বপন থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত ২২টি ধাপের ১৭টি ধাপ এখনও কিষানির ওপর নির্ভরশীল। ৭৭% গ্রাামীণ নারী কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের শ্রমের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতি দেবার জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জনকণ্ঠকে জানান কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান যুগ্ম সচিব মনজুরুল আনোয়ার। তিনি বলেন, সাভারের হেমায়েতপুর এলাকা সম্প্রতি সফর করেছেন তিনি। সেখানে দেখেছেন সরকারের পরিচালিত কৃষক মহিলা ক্লাবে নিয়মিত কাজ করছেন কৃষিজীবী নারী। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও কৃষিজীবী নারী অনেক সচেতন বলে জানান তিনি। মনজুরুল আনোয়ার বলেন, নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের কৃষিখাত এগিয়ে নেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। কৃষি এবং বিভিন্ন শিল্পে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে দেশের ৫৩ শতাংশ গ্রামীণ নারী। এ ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা (৪৭%)। গ্রামীণ নারী রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এ শ্রমকে কাজে লাগানো হলেও তার কোন মূল্যায়ন বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। ‘ইনসিডিন বাংলাদেশ’ নামের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান (এফএও) উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে নারীর মালিকানাধীন কৃষিজমির পরিমাণ ৩.৫ শতাংশ। প্রায় ২০ বছর পর এ জমির পরিমাণ হ্রাস পেয়ে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৪৩ শতাংশ আর মোট শ্রমশক্তির ৭৮ শতাংশ কৃষি কাজে নিয়োজিত। সৃজনশীলতা থাকা সত্ত্বেও ৪৩.৩ শতাংশ নারীকে গৃহস্থালিতে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, যেখানে পুরুষ মাত্র .৯ শতাংশ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী আর বৈষম্যমূলক নীতির কারণে ৯.৪ শতাংশ নারীর বিপরীতে ৩৪.৫ শতাংশ পুরুষ অর্থ উপার্জন করে। নারীর কর্মক্ষেত্রকে অর্থনীতির মূলধারার বাইরে বিবেচনা করায় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ধারাবাহিক-সরকারীভাবে মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮% শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। জরিপে জানা যায়, কর্মক্ষম নারীর মধ্যে কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত রয়েছেন। ফসলের প্রাক-বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমনকি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ নারী এককভাবেই করে। জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালে ঘোষিত নারীর প্রতি বিরাজমান সব রকম বৈষম্য বিলোপের দলিল যা সংক্ষেপে ‘সিডও সনদ’ নামে পরিচিত। কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্বখাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল ১৯৮৪ সালে কৃষিতে নারী, ১৯৯৯ সালে ‘অন্ন জোগায় নারী’ প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছিল। ২০১১ সালে প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে মোট ৩টি ভাগে ৪৯টি অধ্যায় রয়েছে। এই তিনটি ভাগে রয়েছে ১৬.১-বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী- পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, ২৩.১০-সরকারের জাতীয় হিসাবসমূহে, জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি ও গার্হস্থ্য শ্রমসহ সব নারী শ্রমের সঠিক প্রতিফলন মূল্যায়ন নিশ্চিত করা, ২৬.১ নারী শ্রমশক্তির শিক্ষিত ও নিরক্ষর উভয় অংশের কর্মসংস্থানের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা, কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে খাদ্য-নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৃষির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক যেখানে নারী সেখানে নারীর উন্নয়ন ব্যতীত দেশের কোন সেক্টরের উন্নয়ন অসম্ভব। দেশে প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব দিলে বৈষম্য থেকে এ অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা সম্ভব। কৃষিতে নারীর অবদানের কথা অস্বীকার না করলেও আধুনিক কৃষিতে নারীর অবদান কমে আসছে বলে মনে করেন কৃষিবিদ রেজাউল করিম সিদ্দিকী। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বাণিজ্যিক কৃষির কারণে এখন মানুষ আর ঘরের বীজ ব্যবহার করেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষক ডিলারদের নিকট থেকে বীজ কেনেন। আবার ফসল চাষের ক্ষেত্রে সকল এলাকার কৃষক পরিবারের মহিলারা মাঠে কাজ করেন, এটা বলা যাবে না। রেজাউল করিম সিদ্দিকী বলেন, উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শ্রমজীবী পুরুষ কাজের খোঁজে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরে চলে যায়। সেসব এলাকার অনেক মহিলা এখন মাঠে কাজ করেন। কারণ গ্রামে এখন ফসল চাষের মৌসুমে শ্রমিক সঙ্কট থাকে। এখানে যারা যুক্ত হন তারা কিষানি হিসেবে নয়, শ্রমিক হিসেবে। ফসল উত্তোলনের স্তরে মাড়াই এখন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলে গেছে। ধান ফসলের একটা বড় অংশ চলে যায় রাইস মিলে। অতএব ধান থেকে চাল বানানোর কাজটি এখন মহিলাদের হাতে নেই। কৃষির যে স্তরে মহিলারা বেশি অবদান রাখেন সেটি হলো পারিবারিক কৃষি-আঙ্গিনায় সবজি চাষ, গাছপালা-গরু বাছুরের যতœ। সিডিপি আয়োজিত ‘অর্থনীতিতে নারীর অবদান নিরূপণ: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ সংলাপে জানা যায় একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২.১টি কাজ করে ৭.৭. ঘণ্টা ব্যয় করেন। পুরুষ ২.৭টি কাজে ব্যয় করেন ২.৫ ঘণ্টা। অর্থাৎ নারী-পুরুষের তুলনায় ৩ গুণ বেশি কাজ করেন। জাতীয় আয়ে নারীর যে পরিমাণ কাজের স্বীকৃতি আছে তার চেয়ে ২.৫ থেকে ২.৯ গুণ কাজের স্বীকৃতি নেই। নারী যে পরিমাণ কাজে স্বীকৃতি আছে সে হারে ২.৫ গুণ কাজের স্বীকৃতি নেই। নারীর ঘরোয়া কাজের আর্থিক মূল্য বিগত অর্থবছরের জিডিপির ৭৬.৮০ শতাংশ। চলতি টাকার মূল্যে তা ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। স্থানীয় মূল্যে এটা ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮শ’ ৪৫ কোটি টাকা। আমাদের নারীদের গৃহস্থালির কাজ রান্না, বাড়িঘর পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা, সদস্যদের সেবাযতœ,পরিচর্যা-সহায়তা এগুলোর কোন শ্রমমূল্য নেই। যদি গৃহস্থালি শ্রম কিনতে হতো তখন তার মূল্য জিডিপির ৮৭.২ হতো, যার আর্থিক মূল্য ১১ লাখ ৭৮ হাজার ২ কোটি টাকা। স্থায়ী মূল্যে এর পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। মজুরিবিহীন কাজে সম্পৃক্ত নারীর মধ্যে ৩ চতুর্থাংশ মজুরি পাওয়া যাবে এমন কাজ করতে আগ্রহী নন। শহরে এর সংখ্যা ৮০.১৭% আর গ্রামে ৭১.১১%। মজুরি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী নন এমন নারীর ৬০% বলেছেনÑ পরিবার চান না তারা বাইরে কাজ করুক। মজুরির টাকা খরচ করতে ৪০% নারীকে পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আর ৫১.৭% নারী নিজেদের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারেন। দেশের ৮৯% নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত আছেন,যারা কোন মজুরি পান না।
×