ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোবারকের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২৫ নভেম্বর ২০১৪

মোবারকের ফাঁসি

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রোকন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত ব্রাক্ষণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার মোঃ মোবারক হোসেনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মুত্যুদ- প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, জোরপূর্বক আটক রাখা, নির্যাতন, লুটপাটের পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে অভিযোগ-১ এ তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মুতুদ- এবং অভিযোগ-৩ এ যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। অন্য তিনটি অভিযোগ-২, ৪, ৫ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিকে খালাস প্রদান করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সোমবার এ আদেশ প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। রায় ঘোষণার পর আইনমন্ত্রী, প্রসিকিউশন পক্ষ, মুক্তিযোদ্ধা, গণজাগরণ মঞ্চ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে আসামি পক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, মোবারক হোসেনের ফাঁসির রায়ে সরকার সন্তুষ্ট। সোমবার (২৪ নবেম্বর) বিকেলে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। আইনমন্ত্রী বলেন, এ রায়ে সরকার সন্তুষ্ট, যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এই বিচারে জনগণের আস্থা ফিরে আসছে বলেও মনে করেন তিনি। এদিকে আদেশ প্রদানের সময় আসামি মোঃ মোবারক হোসেন ছিলেন নির্লিপ্ত। আদেশের পুরো সময় আসামি স্থির হয়ে কাঠগড়ায় বসেছিলেন। রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউটর শাহিদুর রহমান বলেছেন, আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। তিনি আরও বলেন, মোবারক হোসেন এবং তার ছেলে সাক্ষ্য দিতে এসে বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমরা তার ভোটার আইডি দেখে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার আসল বয়স প্রমাণ করতে পেরেছি। যে ৩টি অভিযোগে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পেলেই সেই ৩টি অভিযোগের ওপর আমরা আপীল করব। প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে প্রমাণি, ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। কারণ, আসামি মোবারক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলেই কোন মানবতাবিরোধী অপরাধী পার পেয়ে যায় না। এই রায়ই তার বড় প্রমাণ। অন্যদিকে মোবারকের বড় ছেলে আসাদউল্লাহ বলেছেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করব। মানবতাবিরোধী অপরাধের এটা ত্রয়োদশ রায়। আর ট্রাইব্যুনাল-১ এর ষষ্ঠ রায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এর আগে যে সমস্ত রায় দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদ (মৃত্যুদ-), কাদের মোল্লা (আমৃত্যু কারাদ- (আপীলে মৃত্যুদ-, পরবর্তীতে রায় কার্যকর), দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (মৃত্যুদ-) আপীলে আমৃত্যু কারাদ-, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান (মৃত্যুদ-) আপীল বিভাগেও মৃত্যুদ- বহাল, গোলাম আযম (৯০ বছরের কারাদ-) অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (মৃত্যুদ-), সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (মৃত্যুদ-), আব্দুল আলীম (আমৃত্যু করাদ-) অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ, চৌধুরী মাঈনুদ্দিন এবং চীফ মোঃ আশরাফুজ্জামান খান (মৃত্যুদ-), মতিউর রহমান নিজামী (মৃত্যুদ-) মির কাশেম আলী (মৃত্যুদ-) , জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার (মৃত্যুদ-)। বর্তমানে দুটি ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি)। এগুলোর মধ্যে Ñজাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার ও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম। রায ঘোষণার আগে চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতু রহিম বলেন, উপস্থিত প্রসিকিউশন,আসামি পক্ষ,সুধী ও সাংবাদিকবৃন্দ আজ এ ট্রাইব্যুনাল থেকে আমরা ষষ্ঠ রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছি। এ রায়ের মধ্য থেকে বিশেষ কিছু অংশ এবং আদেশ আমরা পাঠ করব। তবে তার আগে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের ট্রাইব্যুনালে রবিবার এ মামলাটি রায় ঘোষণার আদেশের জন্য কার্যতালিকায় রেখেছিলাম। তা দেখে কিছু টিভি চ্যালেন আগামিকাল রায় ঘোষণা মর্মে ব্রেকিং নিউজ বা সংবাদ প্রচার করে। আদালতের রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আদালত যখন যেমন থাকে তেমনই রিপোর্ট করা উচিত। এমন কিছু করা উচ্তি নয়, যা আদালতের কর্তৃত্ব বা এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এম ইনায়েতুর রহিম আরও বলেন, সকালে একটি চ্যানেলে দেখছিলাম, এক সিনিয়র সাংবাদিক মন্তব্য করছেন দেশে এক বিতর্কিত ব্যক্তি ফিরে এসেছেন। এ ছাড়া পিএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এসবের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণাকে যুক্ত করে তিনি মন্তব্য করছিলেন। ‘আজ (সোমবার) এক পত্রিকায় দেখলাম, সেখানে লেখা হয়েছে ১১টায় রায় ঘোষণা করা হবে । কিন্তু রিপোর্টার সেটা কীভাবে বুঝলেন?’ ট্রাইব্যুনালের রায় ও সমসাময়িক কিছু উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল বলে, আদালতের রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সকলকে আরও সচেতন ও দািয়ত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত এর পর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান রায় পড়া শুরু করেন। মূল রায় ৯২ পৃষ্ঠার। প্রথম অংশ পড়েন বিচারপতি আনোয়ারুল হক, দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও সর্বশেষ দ- ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। আসামি মোঃ মোবারকের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ১ অভিযোগে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। অভিযোগ-১ এ রয়েছেÑ একাত্তরের ২২ আগস্ট বেলা অনুমান দুইটা থেকে আড়াইটা মধ্যে ২৩ আগস্ট ১৯৭১ সন্ধ্যা পর্যন্ত। আসামি মোঃ মোবারক হোসেন ও তার সহযোগী রাজাকারগণ ও পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী আখাউড়া থানাধীন টানমান্দাইল গ্রামের ১৩২ নিরীহ-নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে আটক, নির্যাতন করার পর ৩৩ জনকে গুলি করে হত্যা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় টানমান্দাইল গ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট রাতে মুক্তিযাদ্ধারা পার্শ্ববর্তী তিনলাখপীর ব্রিজ উড়িয়ে দেয়, ফলে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধী ও গঙ্গাসাগর আর্মি ক্যাম্পের পাকিস্তানী আর্মিগণ উক্ত ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া বিষয়ে টানমান্দাইল গ্রামবাসী সহায়তা করে। তারা পরিকল্পিতভাবে এতাত্তরের ২২ আগস্ট আসামি মোঃ মোবারক হোসেন সঙ্গীয় রাজাকার বজলুর রহমান বজু, মুক্তা মিয়াসহ অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকার সশস্ত্র অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার আখাউড়া থানাধীন টানমান্দাইল গ্রামের বাসিন্দাদের উক্ত গ্রামের পূর্ব পাড়ায় নূর বক্স হাজির বাড়িতে মিটিংয়ের নামে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলে। তাহাদের ভয়ে টানমান্দাইল গ্রামের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ আনুমানিক ১১২ জন এবং পার্শ্ববর্তী জাঙ্গাল গ্রামের ৭জনসহ মোট ১৩০/১৩২ গ্রামবাসী বেলা অনুমান ০২.০০/০২.৩০ ঘটিকার সময় নূরবক্স হাজির বাড়িতে হাজির হলে, আসামির পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনারা ছয়টি নৌকাযোগে এসে নূরবক্স হাজির বাড়িটি ঘেরাও করে। পাকিস্তানী সেনারা, আসামি মোঃ মোবারক হোসেন ও অন্যান্য রাজাকারের সহায়তায় স্থানীয় উল্লেখিত নিরস্ত্র-নিরীহ গ্রামবাসীকে অপহরণপূর্বক নৌকাযোগে তথা হতে গঙ্গাসাগর দিঘির উত্তরপারে অবস্থিত কাচারির আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখে। আসামি মোঃ মোবারক হোসেন ও তার এদেশীয় সহযোগীর সহায়তায় গ্রামের সমবেত সবাইকে বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনে নেয় যে, কার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা, কার ভাই-ভাতিজা মুক্তিযোদ্ধা বা কাদের আত্মীয়স্বজন মুক্তিযুদ্ধে গেছে। এরপর তারা গ্রামবাসীদের বাছাই করে। যাদের আত্মীয়স্বজন মুক্তিযুদ্ধে গেছে তাদের আখাউড়া থানাধীন গঙ্গাসাগর দিঘিরপারে কাচারি সংলগ্ন তেরঝুড়িতে (হাজতখানা) আটক রাখে এবং বাকিদের দিঘিরপারে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের নামে বিভিন্নভাবে অমানবিক নির্যাতন করে। পরদিন অর্থাৎ ২৩ আগস্ট, ১৯৭১ সন্ধ্যার দিকে আটককৃতদের মধ্য হতে টানমান্দাইল গ্রামের শহীদ মোঃ গোলাম কাদির, শহীদ আবুল ফায়েজ, শহীদ মোঃ রিয়াজ উদ্দিন, শহীদ মোঃ তারু মিয়াসহ ২৬ জন এবং পার্শ্ববর্তী জাঙ্গাল গ্রামের শহীদ ওমর আলী, শহীদ সাদন মিয়া, শহীদ মোসলেম মিয়াসহ ৭ জন, মোট ৩৩ নিরীহ-নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে পাকসেনা ও রাজাকাররা গঙ্গাসাগর দিঘির পশ্চিমপারে একত্রিত করে। তাদের দ্বারা কোমর পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে গর্ত করে ওই গর্তে সবাইকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এরপর ওই গর্তে সবাইকে মাটিচাপা দেয়। হাজি নুরবক্সের দুই মুক্তিযোদ্ধা ছেলে আবুল বাসার এবং আবু তাহেরকেও সেদিন হত্যা করা হয়। শহীদদের অধিকাংশের নাম গণকবরের ফলকে লেখা আছে। অন্যদিকে অভিযোগ-৩ এ আসামিকে যাবজ্জীবন করাদ- প্রদান করা হয়েছে। এ অভিযোগে রয়েছে : ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সদর থানার ছাতিয়ান গ্রামের আব্দুল খালেককে অপহরণপূর্বক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার সদর থানার সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে ১৯৭১ সালের ১১ নবেম্বর সকাল অনুমান ৮ টা থেকে ৯টার মধ্যে আসামি মোঃ মোবারক হোসেন রাজাকার কমান্ডার হিসেবে তার সশস্ত্র দলবল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বলে পরিচিত ছাতিয়ান গ্রামের আব্দুল খালেক, পিতা-মৃত জালাল বক্স, থানা ও জেলা- ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে তার বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বের রাস্তা থেকে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। খালেকের ছেলে রফিকুল ইসলামসহ কয়েকজন খালেককে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে দেখে এবং তার পিতাকে মোবারকসহ রাজাকাররা শারীরিকভাবে অমানবিক নির্যাতন করতে দেখে। ক্যাম্পে আটক থাকাকালে ভিকটিমকে তার স্ত্রী ও মেয়ে দেখতে গিয়ে ঐ সময় অপারেশন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রাজাকার কমান্ডারের নাম মোবারক হোসেন@ মোবারক আলী বলে জানতে পারেন। ঐ দিন রাতেই তাকে চোখ ও হাত বেঁধে তিতাস নদীর পশ্চিমপারে বাকাইল ঘাটে নিয়ে আসামি মোবারক হোসেন গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরদিন সকালে নির্যাতনের চিহ্নসহ উক্ত খালেকের লাশ তার আত্মীয়স্বজনসহ এলাকাবাসী তিতাস নদীরপার বাকাইল ঘাট হতে এনে কলামুড়ি গোরস্তানে দাফন করেন। অন্যদিকে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ ২,৪,৫ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে ঐ সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।
×