ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাদের মোল্লার আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় শীঘ্র ॥ ফয়সালা হবে রিভিউ ইস্যুর

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৩ নভেম্বর ২০১৪

কাদের মোল্লার আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় শীঘ্র ॥ ফয়সালা হবে রিভিউ ইস্যুর

আরাফাত মুন্না ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীরা সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর মিলছে শীঘ্রই। যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের দেয়া রায়ের উত্তর মিলছে। সুপ্রীমকোর্টের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজের বিষয়ে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা শেষ হয়েছে। যে কোন সময়ই রায়টি প্রকাশ করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের রিভিউ আবেদন নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, এ পূর্ণাঙ্গ রায়ের মাধ্যমেই তার নিষ্পত্তি হচ্ছে। এই বিতর্ক শুরু হয় গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হওয়ার পর থেকেই। এরপর আরেক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সুপ্রীমকোর্টের রায়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয়ার পরও একই বিতর্ক সামনে আসে। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানকে সুপ্রীমকোর্ট থেকে মৃত্যুদ- দেয়ার পরও সেই একই বিতর্ক নতুন করে শুরু হয়। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপীল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদ- দেন। প্রায় আড়াই মাসেরও বেশি সময় পর ৫ ডিসেম্বর আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ের কপি প্রকাশের পর ৮ ডিসেম্বর সেটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল ওইদিনই কাদের মোল্লার মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে আদেশটি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। রায়ের কপি হাতে পেয়েই তার ফাঁসি কার্যকর করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এক্ষেত্রে তখন জেল কোড অনুযায়ী রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ২১ দিনের আগে নয় ও ২৮ দিনের পরে নয় যে বিধান রয়েছে তা অনুসরণ না করেই ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের জন্য জেল কোডে প্রদত্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে আসামিপক্ষের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে ১০ ডিসেম্বর রাতে সুপ্রীমকোর্টের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন নিজ বাস ভবনে কোর্ট বসিয়ে ফাঁসির আদেশ স্থগিত করেছিলেন। পর দিন কাদের মোল্লার পক্ষে রিভিউ সংক্রান্ত দুটি আবেদন দায়ের করা হয়েছিল আপীল বিভাগে। এর একটি ছিল রিভিউ গ্রহণযোগ্য হবে কি হবে না এবং অন্যটি ছিল তার মূল রিভিউ আবেদন। এই দুই আবেদনেরই শুনানি করে ১২ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি কেবল ঘোষণা দেন যে, বোথ দ্য ক্রিমিনাল রিভিউ পিটিশনস আর ডিসমিসড। রিভিউ আবেদন খারিজের দিন রাতেই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কিন্তু রিভিউ আবেদন কী কারণে খারিজ হয়েছে তা স্পষ্ট করেননি আপীল বিভাগ। ওই সময় শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, সংবিধানের ৪৭(ক) (২) অনুচ্ছেদে মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির রিভিউ আবেদন করার অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীমকোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’ শুনানিতে তিনি বলেন, এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাদের মোল্লার রিভিউ করার অধিকার নেই। কারণ ১৯৭৩ সালে ট্রাইব্যুনালস আইনের বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে দেয়া কোন আদেশ বা সাজা দেশের কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই আইনটি জাতীয় সংসদ প্রণয়ন করেছে। সুতরাং সংসদে প্রণীত এ আইন অনুযায়ী রিভিউ চলবে না। কোন প্রতিকারও চাইতে পারবে না। জবাবে কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, রিভিউ কোন প্রতিকার নয়। এটা সাংবিধানিক ও সুপ্রীমকোর্ট রুলস অনুযায়ী নিজস্ব অন্তর্নিহিত ক্ষমতা। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের যে কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে এবং আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপীল বিভাগের কোন ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’ এখানে সুনির্দিষ্টভাবে আপীল বিভাগের ক্ষমতা বুঝানো হয়েছে। প্রতিকারের কথা বলা হয়নি। এখানে ক্ষমতা হচ্ছে অন্তর্নিহিত। সুপ্রীমকোর্ট কাদের মোল্লা রিভিউ আবেদনের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আদেশ দেয়ার পর বিষয়টি অনিষ্পত্তি অবস্থায় থেকে যায়। এরপর প্রতিটি রায়ের পরই রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষ থেকে রিভিউর বিষয়ে আসে ভিন্ন ভিন্ন মতামত। আসামি পক্ষ দাবি করে আসছিল সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তারা সুপ্রীমকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করতে পারবেন। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষ বলে আসছে, সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় অনুযায়ী কোন যুদ্ধাপরাধী এই সংবিধানের অন্য অনুচ্ছেদে বর্ণিত কোন সুবিধা নিতে পারবে না। সে হিসেবে কোন যুদ্ধাপরাধী রিভিউ আবেদন করারও সুযোগ পাবে না। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে (আপীল বিভাগ কর্তৃক রায় বা আদেশ পুনর্বিবেচনা) রয়েছে, ‘সংসদের যে কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে এবং আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপীল বিভাগের কোন ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের ওপর থাকবে।’ আইনজীবীদের কেউ কেউ মনে করেন, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদই কাদের মোল্লাকে তার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় পুনর্বিবেচনার সুযোগ করে দিয়েছে। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের অযুহাত দিয়েই কাদের মোল্লার আইনজীবীরা রায় পুনর্বিবেচনার কথা জানিয়েছেন। এদিকে সংবিধানের ৪৭ক-এর (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হয়েছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীমকোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’ সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বলা হয়েছে, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য (বা অন্য কোন ব্যক্তি, ব্যক্তি সমষ্টি বা সংগঠন) কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিতে সোপর্দ কিংবা দ-দান করিবার বিধান-সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বা তার পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলে গণ্য হবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হয়েছে বলে গণ্য হবে না।’ সংবিধানের ৪৭(ক) ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের (১) ও (৩) দফা এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের অধীন নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য হইবে না।’ অর্থাৎ- মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার পাবার কথা ছিল তা পাবেন না। ৩৫ অনুচ্ছেদের (১) ও (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পাওয়া অধিকার হারাবেন। এ বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আসামি পক্ষ বলছেন, তারা রিভিউ আবেদন করবেন। আমি আগেরবারও বলেছি, ৪৭(ক) ধারা মতো আমি যা বুঝেছি, রিভিউ চলবে না। তারপরও কাদের মোল্লার রিভিউর রায়ে যদি দেখা যায় যে আদালত ‘রিভিউ চলবে’ বলে মত দিয়েছে, তাহলে সেটাই চূড়ান্ত হবে। আমি ধরে নেব আমার আগের মন্তব্য সঠিক ছিল না। তিনি বলেন, কাদের মোল্লার মামলার রিভিউর রায় যদি আমরা পেয়ে যাই, তাহলেই এ সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঘুচে যায়। মাহবুবে আলম আরও বলেন, আমরা আইনজীবীরা যেভাবে বুঝি সেভাবে আইনের ব্যাখ্যা দেই। কিন্তু তখনই সর্বশেষ আদালত যে সিদ্ধান্ত দেন তাই চূড়ান্ত। এ বিষয়ে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, রিভিউ চলবে না। কারণ তা আইনে নেই। তিনি বলেন, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রিভিউর সুযোগ থাকলেও সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য ওই অধিকার বাতিল করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তবে সুপ্রীমকোর্ট চাইলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাদের নিজস্ব ক্ষমতাবলে রিভিউর সুযোগ দিতে পারেন। এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক জনকণ্ঠকে বলেন, আইনে সব কিছু স্পষ্ট সাদা বা কালো বলে দেয়া থাকে না। সব কিছু বলে দেয়া সম্ভবও নয়। তিনি বলেন, যখন সব কিছু স্পষ্ট বলে দেয়া থাকে না, তখন ওই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকতে হয়। তিনি বলেন, আমি মনে করি সংবিধান অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের মামলায় দ-িতরা রিভিউর সুযোগ পাবেন না। কারণ সংবিধানের মাধ্যমেই সেই সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সুপ্রীমকোর্ট চাইলেই সংবিধানের বাইরে গিয়ে এই সুযোগ দিতে পারেন না। তবে তারা যদি মনে করেন, এই রিভিউর সুযোগ দিলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে তাহলে সুপ্রীমকোর্ট তাদের নিজস্ব ক্ষমতাবলে এই সুযোগ দিতে পারেন।
×