ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে আর কাউকে নিঃস্ব হতে হবে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৯ নভেম্বর ২০১৪

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে আর কাউকে নিঃস্ব হতে হবে না

নিখিল মানখিন ॥ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে তৈরি করা হচ্ছে জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন-২০১৪। এ ব্যবস্থায় বেশি লাভবান হবেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। মূলত নিম্নবিত্তের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনা করেই দেশের সর্বত্র উন্নত চিকিৎসাসেবার অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। ইতোমধ্যে আইনটির খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এ খসড়ার ওপর সবার মতামত চাওয়া হয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি) ব্যবস্থা গড়ে তোলা বিষয়ক আন্তর্জাতিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। আইনটি বাস্তবায়নে গঠিত হবে জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ। এটির আওতায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা অফিস গড়ে তোলার কথা রয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ আইনের উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নে কার্যক্রম পরিচালনা ও মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকবে। এ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেবে কাউন্সিল অব গবর্নরস এবং নির্বাহী বোর্ড। চলতি বছরের মধ্যেই আইনটি পাস করানোর লক্ষ্যে কাজ চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ কথা জানা গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক মোঃ আসাদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থায় চিকিৎসার জন্য কাউকে নিঃস্ব হতে হবে না। নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার বাংলাদেশ সংবিধানে স্বীকৃত। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত লাগবে। এটা অনেক বড় একটি কর্মোদ্যোগ। আশা করি মানুষের স্বার্থে নেতৃবৃন্দ সেটি করবেন। জনগণের স্বাস্থ্যসেবাকে সুরক্ষা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা, বীমার ব্যবস্থা করাÑ এ কাজগুলোর জন্য সুরক্ষা আইন লাগে। খসড়ার ওপর যে কেউ মতামত দিতে পারেন। চলতি বছরের মধ্যেই আইনটি পাস করানোর লক্ষ্যে কাজ চলছে। জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া ঘেঁটে দেখা গেছে, সুরক্ষা তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহের ৮টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে। এই খাতগুলো থেকে বার্ষিক ভিত্তিতে তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হবে। সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিচারে ৫টি গ্রুপে বিভক্ত করে হেলথ কার্ডের আওতায় আনা হবে। গ্রুপগুলো হচ্ছে- দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, ন্যূনতম আয়ভুক্ত গ্রুপ, মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রম বসবাসকারীরা। আইনটি পাস এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পাবে বলে জানান মোঃ আসাদুল ইসলাম। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইনটি বাস্তবায়নে গঠিত হবে জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ। এটির আওতায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা অফিস গড়ে তোলার কথা রয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ আইনের উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নে কার্যক্রম পরিচালনা ও মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকবে। এ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেবে কাউন্সিল অব গবর্নরস এবং নির্বাহী বোর্ড। আইনটির খসড়ায় বলা আছে, কাউন্সিল অব গবর্নরস তৈরি হবে ১৬ সদস্যের সমন্বয়ে। পদাধিকারবলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই কাউন্সিলের নেতৃত্ব দেবেন। আইনের আওতায় ৫ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী বোর্ড কাজ করবে। এই বোর্ডের সভাপতি কাউন্সিল অব গবর্নরসের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করবেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠিত স্থানীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা অফিস সেবাগ্রহীতাদের জন্য স্বাস্থ্য কার্ড ইস্যু করবে। ব্যক্তি ও বাসাবাড়ি পর্যায়ে প্রিমিয়াম জমাদানের হার নির্ধারণ ও নিয়মিত আদায় করবে। এছাড়া রোগী রেফারেল পদ্ধতি গড়ে তোলার কাজও সমন্বয় করবে স্থানীয় অফিস। খসড়ায় আরও একটি কমিটি গঠনের কথাও বলা আছে। সেটি হলো তিন সদস্যবিশিষ্ট এ্যাক্রিডিটেশন কমিটি। এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে দুজন ডাক্তার ও একজন চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট থাকবেন। জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা তহবিলের টাকার বৃহদাংশের যোগান আসবে রাষ্ট্রের বরাদ্দ থেকে। আরও থাকছে- কার্ড হোল্ডারদের অংশগ্রহণ (বার্ষিক প্রিমিয়াম), সরকার/অন্য কোন বডির বরাদ্দ, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুদান, কর্তৃপক্ষের অর্থ ধার এবং বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ, অন্যান্য ফি/চার্জ এবং সরকার অনুমোদিত অন্যান্য খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থ। খসড়ায় বলা হচ্ছে, এই তহবিলের টাকা সরকারি ট্রেজারি অথবা অন্য কোন জাতীয় পর্যায়ের ব্যাংকে ডিপোজিট করে রাখা যাবে। কার্ডধারী নাগরিক অসুস্থ হয়ে পড়লে এই তহবিল থেকে অর্থের যোগান দেয়া হবে। আপতকালে অনেকের হাতে প্রয়োজনীয় টাকা থাকে না। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ধারণায় এজন্যই সেবাগ্রহীতাদের বিপদকালে ব্যবহারের জন্য অংশগ্রহণমূলক ভিত্তিতে অগ্রিম টাকা জমা রাখার গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে। যাতে মানুষের অসহায় অবস্থায় সুরক্ষা দিতে পারে এই তহবিল। হেলথ কার্ডধারীদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হলে অবশ্যই জেনারেল প্র্যাকটিশনারের মাধ্যমে রেফার হয়ে আসতে হবে। তবে মরণাপন্ন রোগীদের দ্রুত সেবার স্বার্থে রেফার লাগবে না। এ ধরনের মুমূর্ষু রোগীদের সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। সুরক্ষা তহবিল এবং প্রিমিয়াম সম্পর্কে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের অংশগ্রহণের টাকা (প্রিমিয়াম) সরকার পরিশোধ করবে। ন্যূনতম টাকা উপার্জনকারী গ্রুপের প্রিমিয়াম হবে সর্বনিম্ন। মধ্যবিত্ত গ্রুপের প্রিমিয়ামের টাকা ন্যূনতম গ্রুপের চেয়ে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বেশি নির্ধারণ করা যাবে। উচ্চ মধ্যবিত্ত গ্রুপের প্রিমিয়ামের পরিমাণ মধ্যবিত্তদের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি করা যাবে। চাকরিজীবীদের বেলায় বার্ষিক প্রিমিয়ামের টাকার অর্ধেক চাকরিদাতা কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইনটি চূড়ান্ত হলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসাসেবার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এজন্য উপযুক্ত স্কিম তৈরি করবে রাষ্ট্র শুধু অতি দরিদ্ররাই নয়, মধ্যবিত্ত ও অবস্থাপন্ন লোকরাও এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা সহায়তার গ্যারান্টি পাবেন। এ পদ্ধতি অনেকটাই স্বাস্থ্যবীমার মতো। সুবিধাপ্রার্থীদের দেয়া হবে হেলথ কার্ড। এই কার্ডধারীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ সেবা সংশ্লিষ্ট পয়েন্ট থেকে পাওয়ার অধিকার ভোগ করবেন। রাষ্ট্র গেজেট প্রকাশ করে কতটুকু সেবা চাওয়ামাত্রই পাওয়া যাবে তার সীমারেখা নির্ধারণ করে দেবে। সময়ভেদে হালনাগাদ হবে এই সীমারেখাও। কিছু সেবা পাওয়া যাবে ফ্রি। সেবার বিনিময়ে আদায়যোগ্য অন্যান্য মূল্যও নির্ধারিত থাকবে। খরচের যোগান দিতে গঠিত হবে জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা তহবিল। এই তহবিলে রাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে। অংশগ্রহণ থাকবে সেবাগ্রহীতাদেরও। স্বাগত জানানো হবে যে কোন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের অনুদান। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই প্রক্রিয়ায় কার্ডধারী নাগরিক অসুস্থ হলে টাকার অভাবে চিকিৎসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন না। জাতীয় তহবিল থেকে নাগরিকের চিকিৎসা খরচ পরিশোধে সেবার ধরনভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেয়া হবে। এতে মানুষের পকেট থেকে স্বাস্থ্য ব্যয়ের পরিমাণও কমবে। বাড়বে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ। বর্তমানে মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ অর্থ নিজের পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট টাকা বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, বর্তমানে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ২৭ ডলার। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত বরাদ্দের চেয়ে অনেক কম। এতে পরিবারের অসুস্থ সদস্যের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে জমি-জিরাত, সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবার। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থায় চিকিৎসার জন্য কাউকে নিঃস্ব হতে হবে না। নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার বাংলাদেশ সংবিধানে স্বীকৃত। কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থ সঙ্কট, পরিকল্পনায় দৈন্য, লুটপাট, দুর্নীতি, সেবাকর্মীদের অনীহা ও দায়িত্বে অবহেলার মতো বহুমুখী সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের ওই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বিরাজ করছে একই চিত্র। উন্নত দেশগুলোর নাগরিকরা টাকা দিয়ে সেবা কিনে নিতে পারছেন। উন্নয়নশীল দেশের বিত্তশালীদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। টাকার অভাবে স্বাস্থ্যসেবা বিমুখ হচ্ছেন প্রধানত দরিদ্ররা। সেবা কিনতে না পেরে অনেক দরিদ্র মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারাও যায়। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা পদ্ধতি গড়ে তোলার তাগিদ দিয়ে আসছে। এই পদ্ধতিতে সেবার আওতায় চলে আসতে পারে অতি দরিদ্ররাও। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটকে বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি) ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে শক্তিশালী করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০১২-২০৩২ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদে স্বাস্থ্যসেবায় অর্থায়নবিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে।
×