ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের ভিতরে এটা ‘শীতল যুদ্ধের’ সময় নয়

প্রকাশিত: ০৪:২২, ১৯ নভেম্বর ২০১৪

আওয়ামী লীগের ভিতরে এটা ‘শীতল যুদ্ধের’ সময় নয়

প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের কিছু বক্তব্য নিয়ে চায়ের পেয়ালায় যে তুফান তোলা হয়েছিল তার রেশ এখনও মেটেনি। এইচ টি ইমাম তাঁর বক্তব্য সম্পর্কে একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাতে গুজবের ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ হয়নি। এই গুজবের ঘুড়িটি উড়িয়েছিল মুখচেনা দুটি ‘নিরপেক্ষ’ পত্রিকা। এখন দেখছি নাটাইয়ের হাত বদল হয়ে গেছে। এখন আওয়ামী লীগের ভেতরেই একটি গ্রুপ এই নাটাই ঘোরাতে শুরু করেছেন। এইচ টি ইমামের বিরুদ্ধে যত রাগ ও ক্ষোভ এবার পুঞ্জীভূত হয়ে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছে। এইচ টি ইমামের বক্তব্যকে বিকৃত করে ছেপে দুটি ‘নিরপেক্ষ’ পত্রিকাতে আসলে হাসিনা সরকারকেই ঘায়েল করতে চেয়েছে, সে সম্পর্কে গত সোমবার ঢাকায় আরেকটি দৈনিকে আমার কলামে মন্তব্য করায় ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের এক বন্ধু আমাকে টেলিফোনে উষ্মার সঙ্গে বলেছেন, ‘আপনি রাসপুটিনকে রক্ষার চেষ্টা করছেন কেন’ অর্থাৎ এইচ টি ইমামকে তুলনা করা হচ্ছে রাশিয়ার অত্যাচারী জারের আরও দুর্বুদ্ধির অধিকারী উপদেষ্টা রাসপুটিনের সঙ্গে। এখন গুজবের ঘুড়ি লন্ডনের আকাশেও এসে পৌঁছেছে। প্রবলভাবে ছড়ানো হচ্ছে, এইচ টি ইমাম কয়েক দফা প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করেছিলেন। তিনি টেলিফোন ধরেননি। অর্থাৎ এইচ টি ইমামের সুদিন ফুরিয়েছে। কেবিনেট বৈঠকেও তাঁর বক্তব্য সম্পর্কে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। কেবিনেটের কয়েকজন সিনিয়র সদস্যই নাকি প্রধানমন্ত্রীর উপর চাপ দিচ্ছেনÑ তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। এই সিনিয়র সদস্যদের তিনজনের মধ্যে দুজনই এক এগারোর সময় ছিলেন আওয়ামী লীগের সংস্কারপন্থী গ্রুপের পালের গোদা। তখন এইচ টি ইমাম একজন সাবেক আমলা হয়েও শেখ হাসিনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের যেসব বন্ধু ভাবছেন আমি এইচ টি ইমামকে রক্ষা করার জন্য লেখালেখি করছি, তাদের আশ্বস্ত করার জন্য বলতে পারি, এইচ টি ইমামকে রক্ষা করার সাধ্য আমার নেই। এটা প্রধানমন্ত্রীর মর্জি। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাম-লীতে মাঝেমধ্যেই রদবদল হতে পারে, তাতেও অস্বাভাবিক কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে তাঁর কোন উপদেষ্টা বা মন্ত্রীর টেলিফোন পেয়ে রিসিভার না তুলতেও পারেন, তাতেও গুজব ছড়াবার তেমন কিছু নেই। যারা এই খবরে উল্লসিত হয়েছেন, এক এগারোর সময় প্রধানমন্ত্রী তাদের কারও কারও মুখ দর্শন পর্যন্ত বন্ধ করেছিলেন। মন্ত্রিসভাতেও দীর্ঘকাল স্থান দেননি। তাতে কি হয়েছে? তারা তো আবার মন্ত্রী হয়েছেন। রাজনীতিতে চিরশত্রু, চিরমিত্র বলে কেউ নেই। তৌফিক ইমামের বয়স হয়েছে। তিনি এই রাজনীতির খেলাটা জানেন। তৌফিক ইমামের বক্তব্য নিয়ে আমি একবার নয়, দু’বার যে লিখতে বসেছি, তার কারণ, তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সখ্য নয় কিংবা তার বিরুদ্ধে বাজারে যত অভিযোগ, তা খ-ন করাও নয়। এসব অভিযোগ সত্য হলে তার বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় (কোন কোন মন্ত্রী ও উপমন্ত্রীকেও রেহাই দেয়া হয়নি) তাহলে আপত্তি করার কিছু ছিল না এবং এখনও নেই। কিন্তু ঢাকায় ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন এবং ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় তার যে বয়ান বিকৃতভাবে ছাপা হয়েছে, তা পাঠ করে এবং তার রেকর্ডকৃত আসল বক্তব্য শুনে আমার মনে হয়েছে, এই প্রচারণার আসল টার্গেট এইচ টি ইমাম নন। আসল টার্গেট শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার। লতিফ সিদ্দিকীর হঠকারী বক্তব্য নিয়ে সরকারকে ঘায়েল করতে না পেরে এখন তৌফিক ইমামের কাঁধে ভর করা হয়েছে। এই অসাধু ও উদ্দেশ্যপরায়ণ সাংবাদিকতার মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। এই মুখোশ উন্মোচনের জন্যই আমার এই দ্বিতীয় দফা কলম ধরা। নইলে বিষয়টির অন্য কোন গুরুত্ব ছিল না। ক্ষমতায় অথবা ক্ষমতার অতি কাছাকাছি থাকার অনেক সুবিধার মধ্যে একটা বড় অসুবিধা এই যে, তা মিত্রের চাইতে শত্রুর সংখ্যা বেশি বাড়ায়। ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে তার দুই প্রভাবশালী আমলা উপদেষ্টা পিএন হাকসার ও ডিপি ধরকে সরিয়ে দেয়ার জন্য কংগ্রেসের ভেতরেও ষড়যন্ত্রের কমতি ছিল না। ষড়যন্ত্রকারীরা জানতেন এ দুজনকে সরানো না গেলে ইন্দিরা গান্ধীকে দুর্বল ও কাবু করা যাবে না। বাংলাদেশে এইচ টি ইমাম অবশ্য ভারতের পিএন হাকসার বা ডিপি ধরের মতো প্রভাবশালী অথবা তাদের মতো সুনামের অধিকারী ব্যক্তি নন। কিন্তু বাংলাদেশে একটা কথা চাউর আছে যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর পরামর্শ শোনেন এবং উপদেষ্টাদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী। এটাই তার জন্য কাল হয়েছে। যদি দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার বা অতি ব্যবহারের জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠত এবং এই ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি উঠত এবং দাবিটি উঠত দলের ভেতর থেকেই তাহলেও আমার বা আর কারও কিছু বলার ছিল না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে কিছু কথা বলে দল ও সরকারকে হেয় করার। তাও এই বক্তব্য জানার মেইন সোর্স এমন একটি পত্রিকা বা দুটি পত্রিকা, যারা এই সরকারকে হেয় করার জন্য অনবরত খবর টুয়িস্ট করে চলেছে। তাদের চক্রান্ত সফল করার কাজে প্রকারান্তরে সাহায্য যোগানো তো আওয়ামী লীগের কোন মহলেরই উচিত নয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে যারা তৌফিক ইমামের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের উচিত ছিল তাকে ওই বৈঠকে ডেকে আনা এবং তার বক্তব্য সম্পর্কে তার নিজের ভাষ্য জানা। তিনি তাদের সন্তুষ্ট করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীই সিদ্ধান্ত নেবেন এই ব্যাপারে তিনি কি করবেন। আর তিনি সন্তুষ্ট করতে পারলে যে বাইরের চক্র তার বক্তব্যকে বিকৃতভাবে প্রচার করে সরকারকে হেয় করতে চাইছে, সেই চক্রের প্রচারণা ব্যর্থ করার জন্য আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সদস্য, সমর্থক সকলের ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানো এবং তৌফিক ইমামকে ডিফেন্ড করা। তা না করে দলের ও সরকারের একশ্রেণীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যা করছেন তা নিজেদের জন্যই বিভেদাত্মক ও আত্মঘাতী নীতি। আওয়ামী লীগের একদল আত্মসন্তুষ্ট নেতা বা মন্ত্রী হয়ত ভাবতে পারেন, বর্তমান সময়টা আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত সুসময়। তাই তারা আত্মবিবাদে গা ভাসিয়েছেন। অনেক বড় বড় সাম্রাজ্য এই ধরনের আত্মসন্তোষ ও আত্মবিবাদে ধ্বংস হয়েছে। বাইরের আক্রমণ দরকার হয়নি। বর্তমান আওয়ামী লীগের আত্মসন্তুষ্ট একশ্রেণীর নেতা যদি দূরদর্শী হতেন, তাহলে তারা দেখতে পেতেন বর্তমান সময়টা তাদের জন্য সুসময় নয় বরং দুঃসময়। সমুদ্রের উপরিভাগ শান্ত দেখে নিচে কি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিস্রোত প্রবাহিত হচ্ছে তা বোঝা যায় না। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শত্রুতা ও সংঘাত এখন দেখা যাচ্ছে না বটে; কিন্তু শত্রুপক্ষ বসে নেই। এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য তারা নেপথ্যে বসে একটার পর একটা দাবার ঘুঁটি চালছে। এইচ টি ইমামের বক্তব্য বিকৃতভাবে প্রচার করাও এই দাবার ঘুঁটির একটি। আওয়ামী লীগের দলে বা সরকারে এমন কোন নেতা বা কর্মী যদি থাকেন, যাদের এইচ টি ইমামের বিরুদ্ধে জেনুইন অভিযোগ আছে, তাদেরও এই সময়ে বা বহিঃশত্রুর ষড়যন্ত্রের মুখে দলীয় ঐক্যে সামান্য চিড় ধরে এমন কোন কাজ করা উচিত নয়। এই সময় আওয়ামী লীগে অটুট ঐক্য প্রয়োজন। ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধন বা ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণের সময় এটা নয়। দুঃসময় কেটে গেলে দলের যে কারও বিরুদ্ধেই গুরুতর অভিযোগ থাকলে তার বিহিত ব্যবস্থা করা যাবে। দেশের ও দলের স্বার্থে একজন রাজনৈতিক উপদেষ্টা কেন, এক ডজন মন্ত্রী বা উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা ক্ষতিকর হবে না বরং জনগণের কাছে তা অভিনন্দিত হবে। কেউ স্বীকার করুন আর না করুন দেশটা এখন চলছে শেখ হাসিনার ধৈর্য, সাহস ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দ্বারা। এ সময় তাঁকে সাহায্য করা দূরের কথা, তাঁর কোন কোন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা কোন কোন সময় বাচাল ও বেফাঁস উক্তি দ্বারা তাঁকে বিব্রত করেন এবং সরকারকেও বিব্রত করেন। লতিফ সিদ্দিকীর উক্তি তার সাম্প্রতিক নজির। সরকারের শত্রুরা এর সুযোগ নেয়। এ জন্যই প্রধানমন্ত্রীর উচিত তাঁর মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের কথা বলায় ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে আনা। অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। আবার বাইরের যে শত্রুপক্ষ মন্ত্রী ও নেতাদেরÑ এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কথাকেও টুয়িস্ট করে বিকৃত ও অসত্য প্রচারণা চালায়, তাদের প্রতিহত করার জন্য শক্তিশালী প্রচার সেল তৈরি করা। এইচ টি ইমামকে আমি দীর্ঘকাল ধরে জানি। আমাদেরই মতো দোষে গুণে মানুষ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লাটা বেশি ভারি। তার মূলে ঈর্ষাও সম্ভবত একটি বড় ফ্যাক্টর। ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা ডিপি ধরের মতো সুনাম তার নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তরুণ তৌফিক ইমাম ডিপি ধরের অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আগরতলায় এক সঙ্গে থাকার সময় সম্ভবত ডিপি ধর তাকে একটি বই পড়তে দিয়েছিলেন। বইটি জুলফিকার আলী ভুট্টোর লেখা ‘মিথ্্ অব ইন্ডিপেন্ডেন্স’। সে সময় তৌফিক ইমাম আমাকে বইটি পড়তে দিয়ে বলেছিলেন, হিটলারের ‘মেইনক্যাম্প’ বইটি পড়লে যেমন তার পরবর্তীকালের ফ্যাসিবাদী অভিসন্ধির কথা জানা যায়, তেমনি ভুট্টোর বইটি পড়লেও বোঝা যায় উপমহাদেশের রাজনীতিতে কী অঘটন ঘটাবার দুর্বুদ্ধি তার মাথায় ঘুরছে। তৌফিকের লেখা বইগুলো পড়লেও বোঝা যায়, তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ-শক্তি কতটা প্রজ্ঞাবান। কোন গুরুতর কারণ না ঘটলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সম্পর্কে প্রচারণায় কান দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না বলেই আমার প্রত্যাশা। [লন্ডন ১৮ নবেম্বর মঙ্গলবার, ২০১৪]
×